ফারুক আহমেদ যেমন দায়িত্ব পাওয়ার কিছুদিন পরই বলেছিলেন, ‘আমি শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য নয়, লম্বা সময়ের জন্য বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সভাপতি থাকতে চাই। বোর্ডপ্রধান পদে থাকার জন্য বিসিবি নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে যা যা করা দরকার, তাও করতে চাই। একটি প্যানেল তৈরি করে বিসিবি (BCB) পরিচালনা পর্ষদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে বোর্ড সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাই। কিন্তু কঠিন সত্য হলো, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সফল প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পেছনের কাহিনি যাই থাকুক, দেশের ক্রিকেট পাড়ায় তীক্ষ্ম বুদ্ধিমান, স্পষ্টভাষী ও খানিক একরোখা চরিত্র বলে পরিচিত ফারুক আহমেদ বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হওয়া তো বহু দূরে, বোর্ডেই থাকতে পারেননি। মূল স্রোতের বাইরে নির্বাচন করতে গিয়েই সর্বনাশ ডেকে আনেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে অনেক দূরে থাকতেই সরে যেতে বাধ্য হন।
ফারুক আহমেদের পরিবর্তে বিসিবি সভাপতির চেয়ারে বসেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। চেয়ারে বসেই ফারুকের মতো সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দেননি তিনি। বুলবুলের মুখে উচ্চারিত হয়নি এমন কথা, ‘আমি বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হতে চাই।’
কিন্তু ভেতরের খবর, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে দায়িত্ব নেওয়া বুলবুল পূর্ণ মেয়াদে নির্বাচিত সভাপতিও হতে পারেন। সে সম্ভাবনাও যথেষ্ট তৈরি হয়েছে।
ভাবছেন, কয়েকদিন আগেই তো জাগো নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এই বলে যে, বুলবুল নির্বাচন করতে চান না। তাহলে এই তিন-চারদিনে এমন কী হলো যে, ফের বুলবুলের সভাপতি হওয়ার প্রশ্ন আসছে? কেন নতুন এমন আলোচনা শুরু হলে সেটি একটু স্পষ্ট করে বলা যাক।
মূলত, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটই এমন দাঁড়িয়েছে যে, বুলবুল চাইলে বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হয়ে যেতেও পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী অক্টোবরে বিসিবির যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোটায় বোর্ড পরিচালক পদে থাকতে পারেন বুলবুল। সময় মতো নির্বাচন হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই বোর্ড নির্বাচন। সেখানে বুলবুল এনএসসির কোটায় পরিচালক হয়ে সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু বোর্ড পরিচালকরা কি তা চাইবেন? যারা অনেক পরিশ্রম করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে এবং গাঁটের পয়সা খরচ করে ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে বোর্ড পরিচালক হওয়ার প্রহর গুনছেন, তারা কি গত ১৫ বছর দেশের ক্রিকেটের বাইরে থাকা বুলবুলকে পূর্ণ মেয়াদে সভাপতি হিসেবে মেনে নেবেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠিক সভাপতি হিসেবে না চাইলেও বুলবুলকে বোর্ডে একটি সম্মানজনক পদে রাখার পক্ষে অনেকেই। সেটা প্রধান নির্বাহী (সিইও) হতে পারে, বোর্ডের চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার করেও রাখা যেতে পারে। বিসিবি পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সেসব তথ্য।
মজার বিষয় হলো- তিনি যেহেতু একবার বোর্ড সভাপতির চেয়ারে বসে গেছেন, এখন তার পক্ষে তো সিইও হওয়া সম্ভব নয়। এখন চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে তিনি আগামীতে বোর্ডে থাকতে চাইবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
তবে এখনকার খবর, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত তিন-চারজন পরিচালক জানিয়েছেন, ক্রিকেটের উন্নয়নে বুলবুল ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। আইসিসিতে দীর্ঘ একযুগের বেশি কাজ করে পেশাদার ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা তিনি শিখে ফেলেছেন। ক্রিকেট প্রশাসন চালাতে হয় কিভাবে, সে ব্যাপারে বুলবুলের খুব ভালো ধারণা আছে। বোর্ড পরিচালনায় কী কী প্রয়োজন, ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে কী কী লাগে, এসব তার নখদর্পণে।
তাই বুলবুলকে যে কোনো মূল্যে বোর্ডে রাখার পক্ষে এসব পরিচালক। তবে সভাপতি পদে বুলবুলকে মেনে নেবেন কি না, সে প্রশ্নের জবাবে কেউই ‘হ্যাঁ-না’ কিছু বলেননি।
কিন্তু এখানে দুটি প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, বুলবুল কি দীর্ঘ মেয়াদে বোর্ড সভাপতি হতে চান? ফারুক আহমেদের মতো সভাপতি হওয়ার স্বপ্ন আছে তার? আবার তিনি চাইলেই হবে না, সভাপতি হওয়ার অনুকূল ক্ষেত্র কী কী আছে সেটাও দেখতে হবে। ভেতরের খবর, বুলবুলের সভাপতি হওয়ার যথেষ্ট ক্ষেত্র আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক সংগঠন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) চাচ্ছে, যদি পূর্বনির্ধারিত সময়ে (অক্টোবরে) বিসিবি নির্বাচন হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের সমর্থনপুষ্ট কাউকে বিসিবি সভাপতি করার। সে হিসেবে সরকার তথা ক্রীড়া পরিষদ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বুলবুলই হচ্ছেন ‘ফার্স্ট চয়েজ’।
কারণ, ফারুক আহমদকে সরিয়ে বুলবুলকেই যেহেতু বোর্ড সভাপতি করেছে বর্তমান সরকার, তাই অক্টোবরে বিসিবি নির্বাচন হলে বুলবুলকেই সভাপতি হিসেবে দেখতে চাওয়ার কথা বর্তমান সরকারের। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এনএসসি চাইলেই নিজেদের পছন্দের ও মনোনীত কাউকে বিসিবিপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে বা পারবে? সোজা উত্তর, সেই সুযোগ রয়েছে। এনএসসি অনুমোদিত বিসিবির গঠনতন্ত্রেই সেই সুযোগ দেওয়া আছে।
বিসিবি পরিচালক পর্ষদে সব সময়ই এনএসসি বা সরকার মনোনীত দুজন পরিচালক থাকার নিয়ম রয়েছে। বলে রাখা ভালো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এনএসসির মনোনীত প্রার্থী হয়েই প্রথমে ফারুক আহমেদ ও পরে বুলবুল বোর্ডে এসেছেন এবং সভাপতি হয়েছেন।
সে হিসেবে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে বিসিবির গঠনতন্ত্র মেনেই দুজনকে পরিচালক পদে মনোনয়ন দিতে পারবে এনএসসি। তারা যদি বাকি নির্বাচিত পরিচালকদের ভোটে সভাপতি হতে পারেন, তখন আর কারোরই কিছু করার থাকবে না। সেটাকে সরাসরি সরকারের ‘হস্তক্ষেপ’ বলাও যাবে না।
কাজেই শেষ কথা হলো, অক্টোবরে বিসিবির নির্বাচন হলে এনএসসি নিয়ম মেনেই তাদের মনোনীত কাউকে বিসিবিপ্রধান করতে চাইতেই পারবে। সেই প্রক্রিয়ায় বুলবুলের বোর্ডপ্রধান হওয়ার পরিষ্কার সম্ভাবনা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুলবুলও এ নিয়ে ভাবছেন। এমনিতে দীর্ঘ মেয়াদে বোর্ডপ্রধানের দায়িত্ব পালনের ইচ্ছে ছিল না। যে প্রক্রিয়ায় বোর্ড সভাপতি হয়েছেন, তাতে ওই সুযোগও ছিল কম। কারণ, ধারণা করা হচ্ছিল, জাতীয় নির্বাচনের পর বিসিবি নির্বাচন হলে হয়তো যে দল সরকার গঠন করবে, তাদের মনোনীত কোনো ক্রিকেট সংগঠকই হবেন বিসিবির পরবর্তী প্রধান।
কাজেই বুলবুল ধরেই নিয়েছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলের কেউ হয়তো বিসিবিপ্রধান হবেন, তার আগে তিনি বোর্ডের কাজকর্ম পরিচালনা করবেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন ধরেই নেওয়া হচ্ছে, আগামী অক্টোবরেই বিসিবি নির্বাচন হয়ে যাবে। তার মানে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই বিসিবি নির্বাচন। যদি তাই হয়, তাহলে এখন অন্তর্বতীকালীন সরকারের মনোনীত বা সমর্থনপুষ্ট কারও বোর্ড সভাপতি হওয়ার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। বুলবুলই হতে পারেন সেই সভাপতি। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। যদি অক্টোবরের নির্বাচনে এনএসসির মনোনীত প্রার্থী হয়ে প্রথমে পরিচালক ও পরে পরিচালকদের ভোটে বুলবুল সভাপতি হন, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পর কী তিনি থাকতে পারবেন?
স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের চিরায়ত ধারা জানান দিচ্ছে, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের মনোনীত কেউ হয়েছেন বিসিবিপ্রধান। স্বাধীনতার পর প্রথম যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর প্রয়াত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাবের হোসেন চৌধুরী, আবার ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আলী আসগর লবি, এরপর ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রথমে আ হ ম মুস্তফা কামাল ও পরে নাজমুল হাসান পাপন ছিলেন বিসিবি সভাপতি।
আগামীতে সংসদ নির্বাচনের পর যে দল সরকার গঠন করবে, ধরেই নেওয়া যায়, সেই দলের ক্রিকেটমনা ও ক্রিকেট অনুরাগী কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যই হয়তো বসবেন বিসিবিপ্রধানের চেয়ারে। অক্টোবরের নির্বাচনে বুলবুল যদি সভাপতি হয়েও আসেন, তিনি কি নতুন সরকার আসার পর পূর্ণ মেয়াদে সভাপতি থাকতে পারবেন? সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, বুলবুল পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, ভাবছেন। একটি সূত্রের খবর, বুলবুল আইসিসির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছেন। কাজেই বিসিবিতে থেকে যাওয়ার অনুকূল সম্ভাবনা থাকলে সভাপতি হবেন বুলবুল।
তবে এ ব্যাপারে বুলবুল খুবই গোপনীয়তা অবলম্বন করছেন। খুব সতর্কতার সঙ্গে সাবধানে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তাই কারও সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়নি।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে অবস্থান করছেন বিসিবির বর্তমান সভাপতি বুলবুল। আগামী ১৭ আগস্ট তার দেশে ফেরার কথা। দেখা যাক, দেশে ফিরে এ ব্যাপারে বুলবুল নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন কীভাবে?
এআরবি/এমএইচ/