ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সাজিদ আবদুল্লাহ। গত ১৭ জুলাই বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর থেকে তার ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সাজিদ ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল, সংস্কৃতিপ্রেমী ও বন্ধুবৎসল স্বভাবের। তার হঠাৎ চলে যাওয়া যেন মানতে পারছেন না কাছের বন্ধুরা।
সাজিদের ময়নাতদন্ত ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, ১৬ জুলাই দিনগত রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার আগে তার মৃত্যু হয়েছে। এদিকে মৃত্যুর আগের দিন ১৬ জুলাই বিকেলে সর্বশেষ তাকে ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি সাজিদের।
তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ সময়ে বন্ধু সার্কেলের কারো সঙ্গেই সাজিদের যোগাযোগ হয়নি। অনেক সহপাঠী কয়েক দফায় তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। তার তিন সহপাঠীর দাবি তারা সাজিদকে ফোন দিলে ফোন রিসিভ হয় কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি। ফলে মাঝখানের এই সময়টাতে সাজিদ কোথায় ছিল, তার ফোন কীভাবে রিসিভ হলো এবং কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।
জানা গেছে, সাজিদদের পাঁচজনের একটি ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ডসার্কেল ছিল। সার্কেলটির অন্য চারজন হলেন ইনসানুল ইমাম, উসামা বিন হাশেম, আজহারুল ইসলাম ও ইমরান জাহান। সবাই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ইনসান আল-হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এবং অন্যরা সাজিদের বিভাগের। চারজনের মধ্যে ইনসান ও আজহারের সঙ্গে সাজিদের পরিচয় হয় ঢাকায় তামীরুল মিল্লাত মাদরাসায় পড়াকালীন। ক্যাম্পাসে আসার পর তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হয়। দুজনের মধ্যে আবার সাজিদের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিল ইনসানের সঙ্গে। এদিকে অন্য দুই বন্ধুর সঙ্গে ক্যাম্পাসে আসার পরে পরিচয়। ক্যাম্পাসে প্রায় সময়ই তারা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া করতেন। ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে সাজিদ, ইনসান ও আজহার একসঙ্গে ছোট পরিসরে একটি ব্যবসাও পরিচালনা করতেন।
সাজিদের বন্ধু ইনসানুল ইমাম বলেন, সাজিদের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিল, এটা সবাই জানতো। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। ক্লাস-পরীক্ষা আর ঘুম ছাড়া প্রায় সময়েই আমরা একসঙ্গে থাকতাম। ক্যাম্পাসে আমি সাজিদকে এভাবে কখনও একা থাকতে দেখিনি। বেশিরভাগ সময় তো আমরাই একসঙ্গে থাকতাম আর আমরা না থাকলেও সঙ্গে জেলার বন্ধু অথবা অন্য কোনো জুনিয়র থাকতো।
ইনসান বলেন, আমার সঙ্গে সাজিদের সর্বশেষ দেখা হয় ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে। ওইদিন দুপুর ২টার দিকে আমার জেলার বড় ভাই উত্তম দাদার সৎকারের উদ্দেশ্য আমি দিনাজপুর গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পরের দিন (১৭ জুলাই) সকাল ৯টায় ক্যাম্পাসে আসি। তখন আমি সোজা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে বিকেল ৫টার পরে। তখন আমি সাজিদকে ফোন দেই কিন্তু তা রিসিভ হয়নি। এর মাঝে ফেসবুকে ঢুকে দেখি পুকুরে একটি মরদেহ ভেসে উঠেছে। কিন্তু তখনও মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। চারুকলা বিভাগের বান্ধবী ঐশীও আমাকে কল দিয়ে পুকুরে মরদেহ ভেসে ওঠার বিষয়টি জানায়। পরে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে সাজিদের নাম্বারে আবার কল দিলে ২৫ সেকেন্ডের জন্য রিসিভ হয়। কিন্তু অপরপাশ থেকে কারও কথা শোনা যায়নি। পরে ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বানী ভাই আমাকে ফোন দিয়ে সাজিদের খোঁজ নিতে বলেন। তখন আমি সাজিদের রুমের সামনে যাই। দরজা বন্ধ ছিল দেখে ধাক্কা দিই।
তিনি আরও বলেন, সাজিদের রুমে সামনে থেকে ছিটকিনি আছে কিন্তু আমি সামনে থেকে রুমের ভেতরের দিকে ধাক্কা দিলে খোলেনি! ওই সময় আমার সেন্স ছিল না যে, বাইরে টান দিলে দরজা খোলে। পরে সাজিদের রুমের দরজা না খুলতে পেরে সেখান থেকে আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পুকুরঘাটের দিকে যাই। গিয়ে দেখি সাজিদের মৃতদেহ! এরপর আমি একেবারেই ভেঙ্গে পড়ি। মরদেহ উদ্ধারের পর সাজিদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমার এক জুনিয়রের মাধ্যমে তার কক্ষ থেকে ফোনটি নিয়ে আসি। সে আনসার সদস্যকে নিয়ে ফোনটি নিয়ে আসে।
সাজিদের সঙ্গে কারোর ব্যক্তিগত মনোমালিন্য ছিল কি না জানতে চাইলে ইনসান বলেন, সাজিদ মোটামুটি সব বিষয়গুলো আমাকে জানাতো। আমার জানামতে কারোর সঙ্গে তার মনোমালিন্য বা এমন কিছু ছিল না।
সাজিদের বন্ধু ইমরান জাহান বলেন, মরদেহ উদ্ধারের আগের রাত ৮টা ৪৮ মিনিটে আমি সাজিদকে কল দিলে ১৪ সেকেন্ডের মতো কল রিসিভ হলেও অপরপাশ থেকে কোন কথা শোনা যায়নি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে কথা শোনা যায়নি। এজন্য আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
আরেক বন্ধু উসামা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন একই মেসে ছিলাম। একসঙ্গে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি ও আড্ডা দিয়েছি। সাজিদের সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাতে। সেদিন আমি বাসায় চলে যাই। পরদিন ১৬ তারিখ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আমার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার বিষয়ে সাজিদের সঙ্গে মেসেজে কথা হয়েছিল। এরপর আর সাজিদের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। পরে ১৭ তারিখ জানতে পারি পুকুরে সাজিদের মরদেহ পাওয়া গেছে।
সাজিদের বন্ধু আজহার ইসলাম বলেন, সাজিদের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয় ১৫ জুলাই দুপুরে। বিভাগ থেকে ফরম ফিলাপের কাজ শেষ করে আমরা একসঙ্গে জিয়া মোড়ে খাওয়া দাওয়া করি। পরদিন ১৬ জুলাই দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের দিকে সাজিদকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেই, ‘ভিজবেন নাকি?’ ম্যাসেজ ডেলিভারি হলেও সাজিদ সেটি সিন করেনি। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শহীদ জিয়া হলে সাজিদের রুমে গিয়ে দেখি রুমে তালা লাগানো। তাকে রুমে না পেয়ে আমি শহীদ মিনারে ছাত্রদলের প্রোগ্রামে চলে যাই। পরদিন ১৭ জুলাই সকাল সোয়া ৭টার দিকে আমরা হল থেকে বের হয়ে জিয়া মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে সাজিদকে ডাক দিলেও কোন সাড়া পাইনি। পরে জিয়া মোড় থেকে চা খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ মিনিটের দিকে ইমরান আমাকে ফোন দিয়ে সাজিদের মরদেহ পাওয়ার বিষয়টি জানায়। খবরটি শুনেই আমি থমকে যাই। যে ছেলেটি ভালো সাঁতার জানতো সে পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে এমনটা মনে হয় না।
আজহার জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটি মেসে ইনসান, সাজিদ ও আমি একই রুমে থাকতাম। ইনসান, সাজিদ, উসামা, ইমরান, মুহিব, রিয়াদ, যায়েদ ও আরিফসহ আমরা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি ও আড্ডা দিতাম। আমরা ছাড়াও রাদিফা, আমেনা, জেমি, খাদিজা, আঁখিসহ জেলার বেশকিছু বন্ধু-বান্ধবীর সাথে সাজিদের চলাফেরা ছিল। তারা একসঙ্গে আড্ডা দিতো। তাদের সেভাবে চিনি না। এছাড়া সাজিদের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে কথা হতো না বা এসব শেয়ার করতো না।
আজহার আরও বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে আমরা সাক্ষাৎকার দিয়েছি। যা জানি বিস্তারিত বলেছি। যতটুকু শুনেছি তার জেলার কোনো বন্ধু-বান্ধবীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। সাজিদ যেহেতু জেলার অন্যদের সঙ্গেও ভালো চলাফেরা করতো। সাজিদ তাদের সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত কিছু বিষয় শেয়ার করছে কি না সেগুলোও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করি।
গত ১৭ জুলাই বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর থেকে সাজিদের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পৃথক দুই কমিটি করা হয়। এরপর কয়েক দফায় মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এর আগে ২১ জুলাই প্রকাশিত ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে মৃত্যুর আনুমানিক সময় উল্লেখ থাকলেও মৃত্যুর ধরন ও কারণ নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা হয়নি। ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য। রোববার (৩ আগস্ট) ভিসেরা রিপোর্টে সাজিদকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে স্বাক্ষরকারী মেডিকেল অফিসারও এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বিষয়টি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
ইরফান উল্লাহ/এমএন/জিকেএস