মতামত

মহানবির ক্ষমার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনা যাচনায় মানবজাতিকে কুরআনের ন্যায় শরিয়ত তথা জীবন বিধান এবং সুন্নতের ন্যায় অনুগ্রহ প্রদান করেছেন। তিনি উন্নত চারিত্রিক আদর্শ শিক্ষা দিয়েছেন, তাদেরকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছেন। মহানবি (সা.) সাহাবীদেরকে তাদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সেবার জন্য অপরিসীম প্রতিদান প্রদান করেছেন। আরবের সাধারণ মানুষদেরকে আকাশের নক্ষত্রে পরিণত করেছেন এবং অসংখ্য সাহাবীদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। হজরত আবু বকর (রা.) যখন খলিফা নির্বাচিত হন তখন তার পিতা এটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, সমগ্র আরব গোত্র তাঁকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে।

একবার হজরত উমর (রা.) হজ থেকে ফেরত আসার সময় এক জনমানবহীন এলাকায় দাঁড়িয়ে যান এবং একটি পাথরের ওপর বসে কাঁদতে থাকেন। এরপর বলেন, আমি আমার পিতার উট এখানেই চড়াতাম। একবার রাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আমার পিতা আমাকে শাস্তি প্রদান করেছিলেন। আর আজ মহানবির (সা.) কল্যাণে আমার ঘামের পরিবর্তে হাজারো মানুষ রক্ত প্রবাহিত করার জন্য প্রস্তুত। এই সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সত্তার কল্যাণে হজরত উসমান (রা.), হজরত যুন্নুরাইন এবং হজরত আলী (রা.) খাতামুল আওলিয়াতে পরিণত হন।

এক দরিদ্র সাহাবি হজরত যাহের বিন হারাম (রা.) গ্রাম থেকে সবজি এনে মদিনায় বিক্রি করতেন। কিন্তু অসুন্দর হওয়ার কারণে লোকজন খুব কমই তার কাছে আসতো। একদিন দুপুরের সময় তিনি ঘর্মাক্ত অবস্থায় বাজারে অবস্থান করছিলেন। মহানবি (সা.) সেদিক দিয়ে যাবার সময় পিছন দিক থেকে এসে অত্যন্ত ভালোবাসার সাথে তার চোখে হাত দিয়ে বলেন, বল তো আমি কে? যাহের (রা.) তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে এটি দেখতে পেয়েছিলেন যে, এই ব্যক্তি রাসুলে করিম (সা.) ব্যতীত আর কেউ হতে পারে না। তখন তিনি (রা.) ভালোবাসার আতিশয্যে মহানবির (সা.) সাথে তার দেহ ঘষতে শুরু করেন। তখন মহানবি (সা.) পরম স্নেহে এক কদম অগ্রসর হয়ে বলেন, আমার এক দাস আছে, কে আছে যে একে ক্রয় করবে? সে নিবেদন করে, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাকে কে ক্রয় করবে? তিনি (সা.) বলেন, এমনটি বলো না! আরশের খোদা তোমাকে ক্রয় করবেন। (শামায়েলুত তিরমিজি)

কে সে যে বিন্দু বিন্দু জলকে একত্রিত করে মহাসমুদ্রে পরিণত করেছে আর কে সে যে বালুকণাকে একত্রিত করে মরুভূমিতে পরিণত করেছে? তিনি ছিলেন বিশ্বনবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি (সা.) ধর্মীয় এবং পার্থিব উভয় জগতের বাদশাহ ছিলেন। যে মক্কা থেকে তিনি (সা.) রাতের আঁধারে গোপনে বের হয়ে এসেছিলেন, সেই মক্কায় তিনি দিনের আলোতে বাদশাহ হয়ে প্রকাশিত হন এবং জিজ্ঞেস করেন, এখন বল! তোমাদের সাথে কীরূপ আচরণ করা উচিত? তিনি (সা.) আল্লাহতায়ালার সিফাত আফু ও গাফুর তথা অতীব ক্ষমাশীল-এর এরূপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন যার উদাহরণ অন্যান্য নবি-রাসুল ও মানবজাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।

মুমিন সিফাতের অর্থ হলো শান্তি বা নিরাপত্তা প্রদানকারী। তদুনযায়ী তিনি (সা.) মক্কা ও মদিনাকে শান্তির শহর বা নিরাপদ নগরী আখ্যায়িত করেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, যে শত্রুই খানা কাবাতে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থাকবে, যে বিলালের পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণ করবে সেও নিরাপদ থাকবে, যে তার নিজ ঘরে অবস্থান করবে সেও নিরাপদ থাকবে। সুরাকা, যে কিনা হজরত রাসুলে করিম (সা.)-কে পাকড়াও করতে এসেছিল, তাকেও তিনি (সা.) নিরাপত্তা প্রদান করেন।

হজরত ইউসুফ (আ.) ‘লা তাসরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা’ বলে তাঁর আপন ভাইদেরকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু হজরত রাসুলে করিম (সা.) মক্কায় তার প্রাণের শত্রুদেরকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তার মেয়ে যয়নাব ও চাচা হামযার হত্যাকারীকেও ক্ষমা করেছিলেন। আবু জাহলের ছেলে ইকরামাকে ক্ষমা করে মক্কায় তার ধর্ম পালনের অনুমতি প্রদান করেন, কিন্তু সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং বলে, হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমি আজ পর্যন্ত আপনার বিরোধিতায় যত সম্পদ ও সময় ব্যয় করেছি, এখন আমি আল্লাহর রাস্তায় এর দ্বিগুণ ব্যয় করবো। তিনি এই অভিযোগ করেন, মুসলমানেরা আমাকে ইসলামের শত্রুর ছেলে বলে থাকে। তখন রাসুলে করিম (সা.) এ কথা বলতেও লোকদের নিষেধ করেন।

বিষ প্রয়োগকারী ইহুদি নারীকে মহানবি (সা.) ক্ষমা করেছেন। সেই ব্যক্তি যে রাসুলে করিম (সা.)-কে একা পেয়ে তরবারি উঁচিয়ে একথা বলেছিল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে-তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন মানব দরদি রাসুল (সা.)। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশার (রা.) প্রতি অপবাদ আরোপকারী মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সুলুলকে হত্যা করার জন্য তার ছেলেকে অনুমতি দেন নি এবং সাহাবিদের বাঁধা সত্ত্বেও তার জানাজার নামাজ পড়িয়েছেন। এরূপ ক্ষমার কোনো দৃষ্টান্ত অন্যান্য নবিদের জীবনে পাওয়া যায় কি? অবশ্যই না।

সালাম অর্থাৎ শান্তি সিফাতের অধীনে তিনি (সা.) পৃথিবীবাসীকে ইসলামের ন্যায় ধর্ম প্রদান করেছেন এবং বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তিকে শান্তি প্রদান কর, হোক সে তোমার পরিচিত বা অপরিচিত। হুনায়েনের যুদ্ধের সময় সফরে এক ব্যক্তি অত্যন্ত শক্ত জুতা পরিধান করে ছিল। তার পা রাসুলে করিম (সা.)-এর পায়ের ওপর চলে আসে, যার ফলে তিনি (সা.) প্রচণ্ড ব্যথা পান। তখন তিনি (সা.) হাতের লাঠি দিয়ে তার পা সরিয়ে দেন। রাসুলে করিম (সা.)-কে আঘাত দেয়ার চিন্তায় সেই সাহাবি অনুতপ্ত ছিল; কিন্তু পরদিন সকালেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে ডেকে পাঠান এবং তাকে ৮০টি বকরি প্রদানপূর্বক বলেন, এটি সেই কষ্টের প্রতিদান যা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। (সুনানুদ দারমি, আল মুকাদ্দামাহ, হাদিস নং-৭৩)

মুমিন সিফাতের অর্থ হলো শান্তি বা নিরাপত্তা প্রদানকারী। তদুনযায়ী তিনি (সা.) মক্কা ও মদিনাকে শান্তির শহর বা নিরাপদ নগরী আখ্যায়িত করেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, যে শত্রুই খানা কাবাতে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থাকবে, যে বিলালের পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণ করবে সেও নিরাপদ থাকবে, যে তার নিজ ঘরে অবস্থান করবে সেও নিরাপদ থাকবে। সুরাকা, যে কিনা হজরত রাসুলে করিম (সা.)-কে পাকড়াও করতে এসেছিল, তাকেও তিনি (সা.) নিরাপত্তা প্রদান করেন।

তিনি (সা.) কীরূপ রউফ ও রহিম তথা অতীব দয়ালু ছিলেন! কিছু চাদর হস্তগত হলে তিনি (সা.) তা সাহাবিদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এক অন্ধ সাহাবী এ বিষয়ে কিছুটা বিলম্বে অবহিত হলে অসন্তুষ্টচিত্তে উপস্থিত হন। তখন রাসুলে করিম (সা.) তার জন্য একটি চাদর নিয়ে বাইরে আসেন এবং বলেন, আমি তোমার জন্য এই চাদরটি রেখেছিলাম।

একবার বকরি জবাই করিয়ে তার কলিজা ভুনা করার নির্দেশ প্রদান করেন। যখন প্রস্তুত হয়ে যায় তখন স্বয়ং সকলের মধ্যে বণ্টন করেন এবং যে সকল সাহাবিগণ অনুপস্থিত ছিলেন তাদের অংশ পৃথক করে রাখেন। (মুসলিম) তিনি (সা.) এরূপ কৃতজ্ঞ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী ছিলেন, হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত খাদিজা (রা.)-এর সেবা ও আত্মত্যাগকে সর্বদা স্মরণ রাখতেন। তায়েফের ঘটনার পর মুতয়িম বিন আদিকে তিনি (সা.) মক্কায় আশ্রয় দিয়েছিলেন, কিন্তু সে কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। বদরের যুদ্ধে বিজয়ের সময়ও তার কথা রাসুলে করিম (সা.)-এর স্মরণে ছিল। তিনি (সা.) বলেন, যদি আজ মুতয়িম বিন আদি জীবিত থাকতো এবং সে এই ৭০ জন বন্দিকে মুক্ত করে দেয়ার সুপারিশ করতো তবে আমি তাদের সকলকে মুক্ত করে দিতাম।

তিনি (সা.) মানুষ ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চরম মার্গে উপনীত ছিলেন। সারা রাত তাহাজ্জুদের নামাজে অতিবাহিত করতেন, এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর পা পর্যন্ত ফুলে যেতো। হজরত আয়েশা (রা.) নিবেদন করেন, আল্লাহতায়ালা তো আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, তবুও আপনি এতো ইবাদত কেন করেন? তিনি (সা.) বলেন, আমি কি আমার প্রভুর কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হবো না?

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com

এইচআরজিকেএস