চাঁদাবাজিতে ‘ওস্তাদ’ ছাত্রলীগের সনি-প্রভাতী

মো. নাহিদ হাসান
মো. নাহিদ হাসান মো. নাহিদ হাসান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৩ এএম, ০১ জুন ২০২৩
ছবিতে শারমিন সুলতানা সনি (বামে) ও আকলিমা আক্তার প্রভাতী

রাজধানীর নীলক্ষেতে অবস্থিত গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স (পুরোনো হোম ইকনোমিক্স কলেজ) কলেজের সামনে রয়েছে একটি লেগুনাস্ট্যান্ড। আবার কলেজের সামনের ফুটপাতের সড়ক ধরে আজিমপুর মোড়ের দিকে এগোলে ফুটপাতেই দেখা মিলবে সারি সারি দোকান। এসব দোকান ও লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদা নেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শারমিন সুলতানা সনি ও সাধারণ সম্পাদক আকলিমা আক্তার প্রভাতী। চাঁদা না দিলে দেখানো হয় ভয়ভীতি।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদন জাগো নিউজের হাতে এসেছে। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ায় পর এসব ঘটনার অনুসন্ধান করেছে জাগো নিউজ এবং তথ্যের সত্যতাও মিলেছে।

আরও পড়ুন: চাঁদা না পেয়ে কাজ আটকে দেওয়ার অভিযোগ ২ ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শারমিন সুলতানা সনি এবং সাধারণ সম্পাদক আকলিমা আক্তার প্রভাতী লালবাগ থানাধীন নিউমার্কেট মোড় থেকে ইডেন মহিলা কলেজ পর্যন্ত মিরপুর রোডের পূর্বপাশের ফুটপাতের ভাসমান হকার্স দোকানদারের লাইনম্যান মো. সোহেলের কাছ থেকে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার তিন হাজার টাকা করে মাসিক মোট ১২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন।

এছাড়াও নিউমার্কেট (নীলক্ষেত ক্রসিং) মোড়ে পথের বন্ধু ফিলিং স্টেশনের সামনে লেগুনা স্টেশন পরিবহনের লাইনম্যান মো. মোহসিন প্রতিদিন চাঁদার টাকা উত্তোলন করে বড় ভাই লাইনম্যান মো. মানিক মৃধার কাছে দেন। মানিক কলেজের দুই নেত্রীকে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার তিন হাজার ৫০০ টাকা করে মাসিক ১৪ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন।

চাঁদা দেওয়ার কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ছাত্রলীগের এ দুই নেত্রী কলেজের সামনে ফুটপাতে দোকান বসলে শিক্ষার্থীদের চলাচলের অসুবিধা হবে, তাই দোকান উঠিয়ে দিতে চান। তখন নিরুপায় হয়ে হকার্সরা তাদের চাঁদা দেন। আর কলেজের সামনে দিয়ে লেগুনা চলাচলের সময় চালক-হেলপাররা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করেন- এমন অভিযোগ করে লেগুনা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাই অনেকটা ভয়ে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগের এই দুই নেত্রীকে চাঁদা দেন তারা।

আরও পড়ুন: এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়া ফেলমু

সরেজমিনে এসব বিষয় অনুসন্ধানের সময় চাঁদা সংগ্রহকারী ব্যক্তিরা তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জাগো নিউজকে জানান, ফুটপাতের দোকানদার এবং লেগুনা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বা কোনো একটি সুবিধাজনক দিনে শারমিন বা প্রভাতী যে কোনো একজনের কাছে তা দিয়ে আসেন তারা। এ দুই খাত থেকে মাসে তাদের ২৫ হাজার টাকার মতো চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া ক্যাম্পাস এলাকার ফুচকা-চটপটির দোকান থেকে তারা চাঁদা নেন। সেখান থেকে মাসে ছয় হাজার টাকা চাঁদা নেন ছাত্রলীগের এ দুই নেত্রী।

jagonews24

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক হকার জাগো নিউজকে বলেন, হ্যাগোর (সনি-প্রভাতী) এখানে বইসা ব্যবসা করবেন আর হ্যাগোরে দেবেন না হেইডা কি হয়। নিয়মিতই এহান থেইক্যা টাহা পায়৷ আমরা কী করমু কন, টাহা না দিলে কাল কইবো কলেজের কোনো মাইয়্যাগোরে টিজ করছে। তহন হগলে তো আমাগোরে পিডাইবো। আমাগো কিছু করনের নাই। চাঁন্দা দেওয়াই লাগবো, নইলে ব্যবসা বন্ধ কইরা দিবো।

লেগুনাস্ট্যান্ডের চারটি লেগুনার মালিক মানিক মৃধার সঙ্গে গত ২৯ মে দুপুরে কথা হয় জাগো নিউজ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘কত টাকা চাঁদা দেওয়া তা মালিক সমিতি বলতে পারে। আমাদের ওখানে লাইনম্যান আছে, তার সাথে একটু কথা বলেন। ওরা এসব জানে ক্যামনে কী করে। আসেন একসময় দেখা করে কথা বলবা নে।’ পরে ওইদিনই বিকেল ৫টায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। এরপর একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরাসহ ৫ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

শুধু ফুটপাত কিংবা লেগুনাস্ট্যান্ডেই নয়, কলেজে কোনো উন্নয়নকাজ এলে সেখানেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দাবি করার অভিযোগ রয়েছে এ দুই ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে। গত ২৪ মে ‘চাঁদা না পেয়ে কাজ আটকে দেওয়ার অভিযোগ ২ ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে’ শিরোনামে জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। এর পরদিনই হলের সংস্কার কাজ শুরু হয়।

চাঁদাবাজির এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শারমিন সুলতানা সনি জাগো নিউজকে বলেন, এগুলো তো সিটি করপোরেশনের রাস্তা। আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা অধ্যক্ষ বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিলাম, এসব উচ্ছেদের জন্য। আমরা যদি বেনিফিটেড (সুবিধাভোগী) হতাম তাহলে কি উচ্ছেদের জন্য সুপারিশ করতাম। আমি কোনো প্রোগ্রামে লেগুনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেলে ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে দিই। কোনো কুচক্রী মহল আমাদের ক্ষতি করার জন্য এসব বলেছে।

আরও পড়ুন: স্টাম্প দিয়ে ছাত্রীকে পেটালেন ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রী

সাধারণ সম্পাদক আকলিমা আক্তার প্রভাতী জাগো নিউজকে বলেন, আপনি একটু ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে দেখেন, কারা এসব নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা এসবের সঙ্গে জড়িত নই। এর আগেও যে নিউজটা হয়েছে আমরা কিন্তু ম্যাডামের (অধ্যক্ষ) সঙ্গে কথা বলে দ্রুত কাজ শুরু করতে বলেছি। আমাদের কমিটি এক বছর হয়েছে, আমরা যদি চাঁদা নিতাম আপনারা আরও আগেই জানতে পারতেন।

শাখা ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা খোঁজ নেবো। অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নাহিদ হাসান/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।