‘হিট আইল্যান্ড’ হয়ে উঠছে সিলেট
সিলেটে নিয়ম মেনে হচ্ছে না বৃষ্টিপাত। স্বাভাবিক থাকছে না দিন ও রাতের তাপমাত্রা। কখনো টানা বৃষ্টি আবার কখনো তীব্র তাপপ্রবাহ। আবার কখনো সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত প্রকৃতিতে দেখা মেলে বহু রূপের। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জানান দেয়, এখন যেন গ্রীষ্মকাল। দিনের দাবদাহ শেষে বিকেলে আবার শরতের আকাশ। পরিষ্কার আকাশে তুলার মতো মেঘ উড়তে দেখা যায়।
আবার কখনো ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আকাশ। কিন্তু নামে না অঝোরে বৃষ্টি। গাছে কদম ফুল ফুটছে ঠিকই, বৃষ্টির সঙ্গ না পাওয়ায় মেলছে না পাঁপড়ি। গত কয়েক বছর ধরেই সিলেটের প্রকৃতিতে এরকম খেয়ালিপনা চলছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (বিভাগীয় প্রধান) ড. মো. আনেয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ুর অতি পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে বৃষ্টিপাত এবং দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। মানুষের অতিমাত্রার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। মানুষের এমন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে আগামীতে আরও বেশি প্রভাব পড়বে সিলেটের প্রকৃতিতে।’

ঋতু পরিক্রমায় বাংলা বর্ষপুঞ্জির আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস নিয়ে বর্ষাকাল। এসময় বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। আর দিনের তাপমাত্রাও থাকার কথা তুলনামূলক কম। কিন্তু সিলেটের প্রকৃতিতে তার উল্টোটা ঘটছে।
‘জলবায়ুর অতি পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে বৃষ্টিপাত এবং দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। মানুষের অতিমাত্রার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। মানুষের এমন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে আগামীতে আরও বেশি প্রভাব পড়বে সিলেটের প্রকৃতিতে।’
আষাঢ়ের প্রথম ১৫ দিনে অর্থাৎ জুন মাসের ১৫ দিনে সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৩১৩ দশমিক ২ মিলিমিটার। আর পুরো মাসে ৩১৬ মিলিমিটার। সে হিসেবে ১৫ দিন বৃষ্টি হয়েছে। বাকি ১৫ দিন নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন:
সিলেটে বন্যা এখন বড় আতঙ্কের নাম
বানে ভাসছে সিলেট: এত ভয়াবহতা আগে দেখেনি কেউ
জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট চাপে বিপন্ন হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, সিলেটে শুধু জুন মাসেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণের বিচ্যুতি ঘটেছে ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রত্যাশার চেয়ে ৪৯ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।

অন্যদিকে, উত্তাপ ছড়াচ্ছে দিনের তাপমাত্রাও। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এপ্রিল-মে মাসে থাকার কথা থাকলেও জুলাই মাসে তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০২২ সালের জুলাই মাসে, ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে, ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
“উঁচু উঁচু দালানের কারণে আমাদের শহরগুলো ‘হিট আইল্যান্ড’ (তাপমাত্রা-প্রবণ অঞ্চল) হয়ে গেছে। তাপমাত্রা বসার জায়গা নেই। উঁচু উঁচু দালান ও এসিগুলোর আউটলেট বাইরে থাকায় সবসময় তাপমাত্রা গরম থাকছে।”
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. মো. আনেয়ারুল ইসলাম বলেন, “উঁচু উঁচু দালানের কারণে আমাদের শহরগুলো ‘হিট আইল্যান্ড’ (তাপমাত্রা-প্রবণ অঞ্চল) হয়ে গেছে। তাপমাত্রা বসার জায়গা নেই। উঁচু উঁচু দালান ও এসিগুলোর আউটলেট বাইরে থাকায় সবসময় তাপমাত্রা গরম থাকছে।”
আগাম-অতিবৃষ্টিতে রেকর্ড
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, মার্চ, এপ্রিল ও মে—এই তিন মাসকে বৃষ্টিপাতের ‘প্রাক্-মৌসুম’ বলা হয়। আর জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস বৃষ্টিপাতের মৌসুম। অক্টোবর ও নভেম্বরকে বৃষ্টিপাতের শেষের মৌসুম বলা হয়।
তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৫৫.৩ মিলিমিটার, এপ্রিলে ৩৭৫.৬ মিলিমিটার, মে মাসে ৫৬৯.৬ মিলিমিটার, জুনে ৮১৮.৪ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৮১৯.২ মিলিমিটার, আগস্টে ৬১২.৬ মিলিমিটার, সেপ্টেম্বরে ৫৩৫.৯ মিলিমিটার ও অক্টোবর মাসে ২৩৬.৯ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। কিন্তু সিলেটের বৃষ্টিপাতের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিমাসে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। কোনো সময় মাসের ১৫-২০ দিন বৃষ্টি নেই। আবার শেষের ১০ দিনে ঝরে। কখনো এক সপ্তাহে মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়েও বেশি বৃষ্টি হয়। এতে বন্যা পরিস্থিতিরও তৈরি হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড করা বিগত পাঁচ বছরের সিলেটের বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সালে প্রাক্ মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৯০৭ মিলিমিটার। আর বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুন-সেপ্টেম্বর চার মাসে দুই হাজার ৯০৬ মিলিমিটার। এর পরের বছর ২০২১ সালে সিলেটে তিন হাজার ৩০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। তার মধ্যে আগাম বৃষ্টি হয়েছে ৫৬০ মিলিমিটার। ওই বছর বর্ষা মৌসুমে দুই হাজার ৪৯৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
‘দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে এপ্রিল-মে মাসে। এখন জুলাই মাস (বর্ষাকাল)। এই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, বিগত পাঁচ বছরে জুলাই মাসের তাপমাত্রা ৩৪.৮ ডিগ্রির নিচে নামেনি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছিল ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’
২০২২ সালে সিলেটে পাঁচ হাজার ১১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তারমধ্যে আগাম বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় এক হাজার ২৬৮ মিলিমিটার। আর ভরা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় তিন হাজার ৪৬৮ মিলিমিটার।
২০২৩ সালে ৮১৭ মিলিমিটার আগাম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় তিন হাজার ৭০৮ মিলিমিটার। ওই বছর পাঁচ হাজার ৩১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

২০২৪ সালে সিলেটে আগাম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে এক হাজার ৩৭৮ মিলিমিটার। একই বছরে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চার হাজার ৩১৫ মিলিমিটার। চলতি বছর সবমিলিয়ে ছয় হাজার ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস।
আরও পড়ুন:
সুপেয় পানির তীব্র সংকট, অকেজো হাজারও নলকূপ
জুলাইয়ে নদ-নদীর পানি বাড়বে, বৃষ্টি ও গরমের কী পূর্বাভাস
প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন টেকসই হবে না: পরিবেশ উপদেষ্টা
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, যে বছর স্বাভাবিকের চেয়ে আগাম বৃষ্টিপাত হয়, সে বছর ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হতে হয় সিলেটকে। মে মাসে সিলেটে স্বাভাবিক বৃষ্টির পরিমাণ ৫৬৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার। কিন্তু ২০২০ সালে মে মাসে বৃষ্টি হয়েছে ৬৪০ মিলিমিটার। এছাড়া ২০২১ সালে ২৯০ মিলিমিটার, ২০২২ সালে ৯০২ মিলিমিটার, ২০২৩ সালে ৩২৯ মিলিমিটার ও ২০২৪ সালে ৮২১ মিলিমিটার। অর্থাৎ ২০২২ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৯ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৫৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই দুই বছরে সিলেটে ভয়াবহ বন্যার জন্য দায়ী আগাম বৃষ্টি ও উজানের ঢল।
আষাঢ়ের তাপমাত্রায় রেকর্ড
দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে এপ্রিল-মে মাসে। এখন জুলাই মাস (বর্ষাকাল)। এই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, বিগত পাঁচ বছরে জুলাই মাসের তাপমাত্রা ৩৪.৮ ডিগ্রির নিচে নামেনি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছিল ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিগত পাঁচ বছর জুলাই মাসের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সালে জুলাই মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২১ সালে ৩৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২২ সালে ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২৩ সালে ৩৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৪ সালে ৩৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ৩৮ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০২২ সালের জুলাইয়ে, ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে, ৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠ মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রচুর সূর্যের আলো গ্রহণ করে বিপুল পরিমাণে জলীয় বাষ্প দেয়। সেই জলীয় বাষ্প বাতাসে নিয়ে এসে আমাদের এখানে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। মৌসুমি বায়ু আগেভাগে চলে আসায় সিলেটে আগাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মাটিতে যে সূর্যের আলো পড়ে, তা জলাভূমি ও গাছপালা কিছুটা শোষণ করে নেয়। কিন্তু জলাভূমি ধ্বংস ও গাছপালা কেটে ফেলায় সেই তাপমাত্রা সরাসরি ফিরে যাচ্ছে। এতে বায়ু গরম হয়ে যাচ্ছে। যখন প্রচুর মেঘের ভেতরে গরম বায়ুর সংঘর্ষ হচ্ছে, তখন বজ্রপাত হচ্ছে। প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে।’
শাবিপ্রবির এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, হাওরে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হলো স্থানীয় পরিবেশ সূর্যের আলো ধারণ করার মতো ক্ষমতা নেই। যে কারণে ১৫ দিন তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে আবার ১৫ দিন বৃষ্টি হয়।
এসআর/এএসএম