ঠাকুরগাঁও পিআইও'র বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি প্রকল্পে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এই অভিযোগ শুধু সদরে নয় জেলার প্রতিটি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় এমপির কিছু ঘনিষ্ঠ নেতারাই সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দকৃত অর্থের তালিকা তৈরি করেন। আর সেই তালিকায় নাম তুলতেও নেতাদের ঘুষ প্রদান করা হয় বলে অনেকে জানিয়েছেন।
সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নভুক্ত গ্রামাঞ্চলের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট স্থাপন, মেরামত ও সংস্কারের জন্য সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দ করা অর্থের সিংহভাগ বণ্টন হচ্ছে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ ও মন্দিরের নামে বরাদ্দকৃত টিআর ও কাবিখার চাল বা গম উত্তোলনের জন্য টন প্রতি প্রায় ৪ হাজার টাকা নিচ্ছেন পিআইও ও তার সহযোগী কর্মকর্তারা।
উপজেলা প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সদর উপজেলায় গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টি আর) সাধারণ কর্মসূচির ২য় পর্যায়ে ২১টি ইউনিয়নের রাস্তাঘাট সংস্কারসহ ২৪৩টি সামাজিক সংগঠনে ৫২ লাখ ১৬০ টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়াও একই অর্থ বছরে (টি আর) কর্মসূচির আওতায় নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক ২য় পর্যায়ে ২৬০টি মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির, শ্মশানঘাট, স্কুল, ক্লাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৮৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
গ্রামীন উন্নয়নের জন্য ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন অর্থায়নে ২১টি ইউনিয়নে প্রায় দেড় শতাধিক ছোট বড় ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। যার নির্মাণ ব্যায় আনুমানিক ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্বে জনপ্রতিনিধিরা থাকলেও দেখভালের দায়িত্বে থাকেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম যোগদানের পর নিজেকে সরকার দলীয় নেতা দাবি করে ইচ্ছেমত অনিয়ম করে চলেছেন বলে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অনেক ঠিকাদার, সেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন।
আউলিয়াপুর ইউনিয়ন এলাকার সুরেশ রায় জানান, আমাদের এলাকায় ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ৬০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে একটি সেতু উদ্বোধনের আগেই ফাঁটল, ইট, বালি ও সিমেন্ট খসে পড়তে শুরু করেছে। প্রকল্প কর্মকর্তাকে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। তিনি আরো বলেন, এলাকায় ব্রিজ পাইছেন সেটাই বড় কথা। ভাঙলে আবার নতুন করে তৈরি করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি দলের ঠিকাদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, একটি ব্রিজ বা কালভার্ট তৈরি করতে ঠিকাদারের বেশি লাভ হয় না। এছাড়া পিআইও, এলাকার নেতাদের কিছু দিয়েই নির্মাণ কাজ শুরু করতে হয়। বরাদ্দ অর্থ থেকে সকলকে দেওয়ার পরে যা টাকা থাকে তা দিয়ে কিভাবে ভালো মানের ব্রিজের কাজ করা সম্ভব। তাই সবকছিু মিলেই কোনোভাবে কাজ শেষ করতে হচ্ছে। পিআইও এতকিছুর পরেও স্থানীয় সরকারি দলের বড় নেতাদের ম্যানেজ করে নিজ এলাকার ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে অন্য জেলার ঠিকাদারকে বেশির ভাগ কাজ দিচ্ছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীরের ঘুষ নেওয়া থেকে উপজেলার রুহিয়া, রাজাগাঁও ইউনিয়ন ছাড়া আর কোনো ইউনিয়নের প্রকল্প রক্ষা পায় না। টিআর এর বরাদ্দ তুলতে গেলে ওই সকল প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কাছে পিআইও ঘুষ গ্রহণ করেন বলেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
রুহিয়া ইউনিয়ন রক্ষা পাওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, অভিযোগের একটিও সত্য নয়। নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু বণ্টন করা হয়। প্রকল্পের বরাদ্দ উত্তোলনের জন্য কারো কাছে ঘুষ নেওয়া হয় না।
ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন অর্থায়নে ২১টি ইউনিয়নে কয়টি ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ ও কত টাকা ব্যয় হয়েছে সেই তালিকা চাওয়া হলে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি কোনো নিউজ প্রকাশ না করারও অনুরোধ করেন। তার লোক এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করবেন বলেও তিনি জানান।
ঠাকুরগাঁও উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুহুল আমিন বলেন, আমি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছে। ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসনের অর্থায়নে বড়গাঁও ইউনিয়নে ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করার পর ফাঁটল সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। সেতু নির্মাণের ঠিকাদারকে নোটিস দেওয়া হয়েছে ও টাকার চেক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঠাকুরগাঁও স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, সরকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। সরকারের উন্নয়ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবহেলা বা দুর্নীতি করা হয়েছে এমন কোনো অভিযোগ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এফএ/এমএস