দেশের মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে অবুঝ সন্তানরা পিতৃহারা, আমি বিধবা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আব্দুল খালেকের মৃত্যুতে তিন সন্তান নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফাতিমা বেগম (২৮)।
চিরতরে বাবার আদর, স্নেহ আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে খালেকের তিন অবুঝ সন্তান। বাবার কফিনের পাশে বসে ছোট্ট শিশুটি কেঁদে কেঁদে বলল, আমার বাবা অসুস্থ, বাবা অসুস্থ!
বাবার মৃত্যুতে ছোট দুই মেয়ে এক ছেলের পড়াশোনা হুমকিতে পড়ে গেছে। একই সঙ্গে অনাগত আরেক সন্তানের দুশ্চিন্তায় এক বুক কষ্ট জমেছে ফাতিমা বেগমের।
করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া পুলিশ সদস্য আব্দুল খালেকের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল খালেকের স্ত্রী ফাতিমা বেগম তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় মেয়ে খাদিজা আক্তারের বয়স ১৩ বছর। মেজো মেয়ে সামিয়া আক্তারের বয়স ১১ বছর। একমাত্র ছেলে সালমান ফারসির বয়স ছয় বছর।
২০০৪ সালে কনস্টেবল পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন আব্দুল খালেক। এরপর সহকারী উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে পদোন্নতি পান। আব্দুল খালেক ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় মারা গেলেও তার পরিবার থাকে বরিশালের একটি ভাড়া বাড়িতে। মূলত বছর দেড়েক আগে বরিশালে কর্মরত ছিলেন আব্দুল খালেক। তাই পরিবার নিয়ে বরিশাল থাকতেন তিনি। পরে তিনি বদলি হয়ে ঢাকা যোগদান করলেও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে পরিবারকে বরিশাল রেখেছিলেন তিনি। অত্যন্ত বিনয়ী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল আব্দুল খালেকের অকাল মৃত্যুতে শোকের ছাড়া নেমে এসেছে তার নিজ এলাকায়। কাঁদছেন তার সহকর্মীরা।
খালেকের পারিবারিক সূত্রে জানায়, চাকরি পাওয়ার আগে নিজ এলাকার একটি মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। চাকরি জীবনেও তিনি ইমামের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন স্থানে কর্মরত অবস্থায়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন আব্দুল খালেক। চাকরিও করতেন স্বল্পবেতনে। তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার জন্য একটি ঘরও বানাতে পারেননি তিনি।
আব্দুল খালেকের শ্যালক মহিউদ্দিন বলেন, আমার বোনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে পড়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। দুই বোনই অত্যন্ত মেধাবী। দুইজনেই পঞ্চম শ্রেণিতে ‘এ প্লাস’ পাওয়ার পাশাপাশি বৃত্তি পেয়েছে। একমাত্র ছেলে পড়ে নুরানি বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে।
তিনি আরও বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বরিশালে বাসা ভাড়া থাকে তারা। নিজেদের মাথা গোঁজার ঘরও তৈরি করতে পারেননি। এর মধ্যে হঠাৎ দুলাভাইয়ের মৃত্যুতে তিন শিশু সন্তানসহ অনাগত আরেক সন্তান নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন বোন। বোনের এই কঠিন দুর্দিনে পুলিশের সহায়তা খুব প্রয়োজন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালেকের স্ত্রী ফাতিমা বেগম বলেন, ছোট তিন সন্তান এবং অনাগত আরেক সন্তানের বাবা যখন মারা যায়, তখন সেই সন্তানদের মায়ের অবস্থা কি হয় তা বলে বোঝানো যাবে না। এমন অল্প বয়সে আমার সন্তানরা বাবাকে হারিয়েছে। অনাগত সন্তানটা তার বাবার মুখটাও দেখতে পারল না। সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারল না তার বাবা।
তিনি বলেন, আমাদের অনাগত সন্তান সাত মাস পর জন্মগ্রহণ করবে। কষ্ট বোঝানোর ভাষা নেই। মা হয়ে আমি অনাগত সন্তানকে বাবার মুখ দেখাতে পারলাম না- এই দুঃখ কিছুতেই ভুলতে পারব না।
আব্দুল খালেক খুব কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন জানিয়ে স্ত্রী ফাতিমা বলেন, যেখানে থাকুক না কেন সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন। তিনি এখন নেই। তিন সন্তান নিয়ে আমি কোথায় যাব? কার কাছে যাব? কোথায় থাকব? কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। দেশের মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সন্তানরা পিতৃহারা; আমি বিধবা।
আব্দুল খালেকের শ্বশুর মো. আব্দুল জলীল খন্দকার বলেন, শবে বরাতের কয়েকদিন আগ থেকে আমার জামাতা অসুস্থ ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হয়। বুধবার সন্ধ্যার পর আমাদের সবার সঙ্গে ফোনে কথা বলে খালেক। আমাদের সবার কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া চায়। এরপর সকালে তার মৃত্যুর খবর শুনতে পাই আমরা।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকায় আব্দুল খালেকের মৃত্যু হয়। ওই দিন রাত ৯টার দিকে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ঝোঁপখালী গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়। তার জানাজা নামাজে ইমামতি করেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন।
জানাজায় অংশগ্রহণ করেন- বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহজাহান হোসেন, বেতাগীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিব আহসান, বেতাগী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন তপু প্রমুখ। এছাড়া জানাজা নামাজে অংশ নেন মরহুমের স্বজনরা।
এরপর মরহুমের ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এমপি ও এসপিসহ উপস্থিত পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা মরহুমের স্বজনদের সান্ত্বনা দেয়ার পাশাপাশি বিপদে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় মরহুমের পরিবারকে নগদ অর্থসহ খাদ্যদ্রব্য সহায়তা দেয়া হয়।
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মারুফ হোসেন বলেন, কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তারপরও কিছু কিছু মৃত্যু গৌরবের। আব্দুল খালেকের আত্মত্যাগ আমাদের ঋণী করেছে। বরগুনা জেলা পুলিশ আব্দুল খালেকের পরিবারের সঙ্গে আছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ তার পরিবারের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে আব্দুল খালেকের পরিবারের পাশে থাকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আমরা পালন করব।
এ বিষয়ে বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, আব্দুল খালেককে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনতাম। অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন তিনি। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত। আমি সবসময় তার পরিবারের পাশে থাকব।
মো. সাইফুল ইসলাম মিরাজ/এএম/জেআইএম