সাগরপাড়ের করোনাযোদ্ধা একদল তরুণ
করোনাভাইরাসের বিষে নীল হয়ে গেছে গোটা দুনিয়া। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তদের সংখ্যা। প্রতিষেধক উদ্ভাবনের চেষ্টায় পৃথিবীর বড় বড় ল্যাবরেটরিতে চলছে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা।
করোনার বিরুদ্ধে কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। এরই ধারাবাহিতায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গোপসাগরের কূলে বেড়ে উঠা বরগুনার একদল স্বেচ্ছাসেবী।
সাগর পাড়ের প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা অদম্য সাহসী ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা গ্রামের অসহায় মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সাধ্যমতো খাদ্য সহায়তা দিয়েও পাশে থাকছেন।
করোনাকালে মানবসেবা চলমান রাখতে তারা ইতোমধ্যে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন। নাম তারুণ্যের আলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সংগঠনের সদস্য প্রায় ৩০ জন। বয়স আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যে। অধিকাংশ সদস্যই গ্রামের বাইরে থাকেন। কেউ সরকারি-বেসরকারি চাকরি করেন, কেউ শিক্ষক, কেউ ছাত্র, আবার কেউবা একেবারেই বেকার তরুণ। সবার বাড়ি বরগুনা সদরের বদরখালী ইউনিয়নের গুলিশাখালী ও পাতাকাটা গ্রামে। এ ইউনিয়ন থেকে সাগর বেশি দূরে নয়।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে কাজ করছেন তরুণ এ দলটি। হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, মুখে মাস্ক, গায়ে এ্যাপ্রোন পড়ে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিদিন গ্রামের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন তারা। ভাইরাসের লক্ষণ, সংক্রমণ ও প্রতিকার নিয়ে গ্রামবাসীদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তারুণ্যের আলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।
গ্রামে ফিরে আসা ছেলেদের নিয়ে বড় পরিসরে সচেতনতামূলক কাজ শুরু করা হয়। প্রথম ধাপে সবাই নিজ নিজ পরিবারকে সচেতন করার দায়িত্ব নিলেন। গ্রামের কয়েকটি লোকসমাগম জায়গায় হাত ধোয়ার জন্য পানির ড্রাম আর সাবানের ব্যবস্থা করা হয় যাতে গ্রামবাসী এখানে হাত ধুতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেরাই সাবান আর পানির ব্যবস্থা করেন। লকডাউনে কর্মহীন হয়েপড়া অভাবি মানুষদের ঘরে ঘরে রাতের অন্ধকারে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যাতে সাহায্যপ্রাপ্তরা কোনো ধরনের হীনমন্যতায় না ভোগেন।
এ সামাজিক সংগঠনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বদরখালী ইউনিয়নের অধিবাসী ও বরগুনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইন্সট্রাক্টর (ইলেকট্রনিক্স) মো. আবু সালেহ। লেখাপড়া করেছেন ঢাকার প্রাইম ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। করোনাকালে তিনি গ্রামে চলে এসেছেন। আত্মনিয়োগ করেছেন গ্রামবাসীকে সচেতন করার কাজে।
জাগো নিউজের সাথে আলাপকালে মো. আবু সালেহ জানান, করোনা আতঙ্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে ছাত্ররা গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামের মানুষের অসচেতনতা দেখে মন খারাপ হয়। তাদের ভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখতে ও বিপদাপন্ন মানুষদের পাশে থাকার চিন্তা থেকেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সংগঠনের ছেলেরা কয়েকটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেবাধর্মী কার্যক্রম চালাতে থাকেন। একটি দল হাতে হ্যান্ড মাইক নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রতিটি মানুষের কানে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেন।
এখন পর্যন্ত নিজেদের টাকায় চলছে তারুণ্যের আলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কার্যক্রম। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিছু অর্থায়ন করেছেন।
বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফ ইলিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ তরুণদের এই উদ্যেগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, এ উদ্যেগের সাথে তিনিও যুক্ত রয়েছেন।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে এলাকার অভাবি মানুষের পাশে থাকতে তিনিও নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রথমদিকে যারা এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন, তারাও এখন প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
ছেলেরা যত্রতত্র আড্ডা দেয়া বন্ধ করেছেন। বয়স্করা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করছেন। কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝেও।
সমাজ সেবার অনুভূতি জানতে চাইলে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের তরুণ প্রভাষক ও স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্য রাশেদুল ইসলাম রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, মাঝে মাঝেই এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা ফোন পাচ্ছি। আশেপাশের এলাকা থেকে মানুষ আমাদের অনুরোধ করছেন তাদের এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী পাঠিয়ে মাইকিং করাসহ নানাভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরির জন্য।আমরাও চেষ্টা করছি আমাদের সাধ্যমতো তাদের ডাকে সাড়া দিতে।
বরগুনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইন্সট্রাক্টর ও তারুণ্যের আলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মো. আবু সালেহ জাগো নিউজকে জানান, যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে চলছি। তাই আমাদের পরিকল্পনা অদূর ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের কার্যক্রম কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা থেকে বিরত থেকেছি। তবে আমাদের ভালো কাজে উৎসাহিত হয়ে অন্যরাও একইভাবে নিজ নিজ এলাকার মানুষের কল্যাণে এগিয়ে এলে সমগ্র দেশের মানুষ উপকৃত হবেন।
এমএএস/এমকেএইচ