করোনায় কুকুরের জন্য দম্পতির ভালোবাসা
করোনা মহামারিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। খেটে খাওয়া দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবেলায় দুস্থ-অসহায় মানুষকে সহযোগিতার পাশাপাশি কুকুরের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন এক দম্পতি। তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন অভুক্ত কুকুরের মুখে।
ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কুকুরের প্রতি এমন ভালোবাসা প্রদর্শনের ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশংসায় ভাসছেন কুষ্টিয়ার পোল্টি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএনবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান নাসির ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান চামেলি জামান।
জানা যায়, প্রতিদিন রাতে কুষ্টিয়া শহর এবং শহরতলীর প্রতিটি রাস্তা এবং অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে কুকুরের মুখে রান্না করা খাবার তুলে দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফেরেন কামরুজ্জামান নাসির ও তার স্ত্রী চামেলি জামান। করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, হোটেল-রোস্তোরাঁ সব বন্ধ। সব কিছু বন্ধ থাকায় সবাইকেই খাবারের জোগান নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষের পাশাপাশি রাস্তার ভাসমান কুকুরগুলোরও চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় এই প্রাণীগুলো রাস্তায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে রয়েছে।
শহর এবং শহরতলীর এসব কুকুরদের খাবারের বেশির ভাগ সংস্থান হয়ে থাকে হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে। হোটেল-রেস্তোরাঁর উচ্ছিষ্ট, ফেলে দেওয়া বাসি-পচা খাবার এবং বাসা বাড়ির ফেলে দেয়া খাবার খেয়েই বেঁচে থাকে এসব কুকুর। করোনার কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর গত মার্চ মাস থেকে প্রতিদিন এভাবে প্রায় শতাধিক কুকুরের মুখে খাবার তুলে দিযেছেন পশুপ্রেমী এই দম্পতি।
শুধু পশু নয়, এই দুর্দিনে তারা দুস্থ ও অসহায় মানুষের পাশেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজ ইউনিয়ন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খোর্দ্দ আইলচারা এবং বটতৈল ইউনিয়নের এক হাজার দুস্থ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন ১৫ দিনের খাবার। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও অর্থ সহযোগিতা করেছেন। স্থানীয় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌর মেয়রসহ ত্রাণ নিয়ে যারা কাজ করছেন সেসব প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকেও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন এই দম্পতি।
সোমবার (১১ মে) রাত ১১ টা। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। রাস্তায় কুকুর-শিয়াল ছাড়া কেউ নেই। এর মধ্যে কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়ার রাস্তায় একটি কালো রংয়ের জিপ এসে থামলো। ৪-৫ টা কুকুর রাস্তায় শুয়ে আছে। গাড়ির শব্দ দাঁড়ালো কুকুরগুলো। গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে কুকুরগুলোর দিকে এগিয়ে আসলেন একজন পুরুষ আর একজন নারী। রাস্তায় রেখে দিলেন খাবারের প্যাকেটগুলো। কাল বিলম্ব না করেই কুকুরগুলো কে কার আগে খাবার খাবে যেন সেই প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। এ দৃশ্য দেখে এই প্রতিবেদক গাড়ির সামনে এগিয়ে যান। এ সময় কথা হয় পশু প্রেমী স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে।
কামরুজ্জামান নাসির বলেন, প্রাণী জগতে কুকুর প্রভুভক্ত ও মানুষের উপকারী বন্ধু। মনিবের জন্য জীবন দেয়ার মত অসংখ্য নজির এদের রয়েছে। এদের একটি অংশ গৃহপালিত। তবে এদের বড় একটি অংশেরই পথেই জন্ম, পথেই বসবাস। তাদের খাবারের জোগান হয় ডাস্টবিন ও নালা-নর্দমায় ফেলে দেয়া গৃহস্থালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশে। করোনাভাইরাসের কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় এবং গৃহবন্দি মানুষের জীবনযাপনে সীমিত রান্না বান্নার কারণে ডাস্টবিন ও নালা-নর্দমায় খাবারের উচ্ছিষ্ট নেই বললেই চলে। এ কারণে পথের এসব কুকুরগুলোকে অভুক্তই থাকতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, মধ্যরাতে ক্ষুধাকাতর কুকুরের আকুল বিলাপে আমার মন কাঁদে এবং আমার মত অনেকেরই হয়তো খারাপ লাগে। এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়, সকল প্রাণী কূলের জন্যও। এভাবে প্রতিদিন রাতে কুষ্টিয়া শহর এবং শহরতলীর এনএস রোড, মজমপুর, চৌড়হাস, হাউজিং, নিশান মোড়, বটতৈলসহ মূল সড়ক ও অলি গলিতে ঘুরে ঘুরে কুকুরদের রান্না করা খাবার দিচ্ছি।
তার স্ত্রী চামেলি জামান বলেন, করোনা দুর্যোগে আমাদের সবার উচিত শিক্ষা গ্রহণ করা। এই দুর্দিনে মানুষের পাশাপাশি একটি পশুপাখিও যেন না খেয়ে থাকে আমাদের প্রত্যেকেরই সে দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত।
আল-মামুন সাগর/আরএআর/জেআইএম