নমুনা দিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করেন অনেকেই, এজন্যই আক্রান্ত বেশি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। প্রতিদিনই গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আর করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্ট প্রাপ্তিতে দেরি হওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
কারণ নমুনার রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত সতর্কতামূলক হিসেবে কেউই বাড়িতে অবস্থান করছেন না। উল্টো তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, করছেন স্বাভাবিক সব কাজ-কর্ম। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের তদারকির অভাবকে দায়ী করেছেন বিশিষ্টজনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১১ এপ্রিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লকডাউন চলছে। কিন্তু মানুষ পুরোপুরি লকডাউন না মানায় ভালো ফল পাওয়া যায়নি। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৩০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাংক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী ও আনসার সদস্যসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছেন।
বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল ছাড়াও জেলার সবকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে জেলায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার কোনো ল্যাব না থাকায় এসব নমুনা জমানোর পর ল্যাব ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পরীক্ষা করা হয়। ঢাকা থেকে পীরক্ষার রিপোর্ট আসতে পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত সময় লাগে। এই সময়টাতে নমুনা দেয়া রোগীদের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো প্রকার তদারকি করা হয় না। ফলে তারা বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করে সুস্থদেরও সংক্রমিত করছেন। বর্তমানে নমুনা দেয়া বেশিরভাগই করোনা পজিটিভ হচ্ছেন। এছাড়া নমুনা সংগ্রহ বুথে সামাজিক দূরত্বের বালাই না থাকায় বাড়ছে সংক্রমণ ঝুঁকি।
তবে জেলার সদর ও নবীনগর উপজেলায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে স্থানীয়দের। গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুন) পর্যন্ত জেলায় আক্রান্ত ৩৫৩ জনের মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৬ জন ও নবীনগর উপজেলায় ৯৫ জন রয়েছেন। নৌপথের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ আসছেন নবীনগরে। করোনার হটস্পট ওই তিন জেলা থেকে আগতদের মাধ্যমেও সংক্রমিত হচ্ছেন নবীনগরের অনেকে। গতকাল বৃহস্পতিবার নবীনগর পৌরসভা এলাকা করোনা সংক্রমণের ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করে লকডাউন ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন।
করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া এক ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ১৬ মে তিনি ও তার ব্যাংকের দুইজন আনসার সদস্য নমুনা দিয়েছিলেন। এরপর ২২ মে তাদের নমুনা রিপোর্ট আসে। ওই কর্মকর্তা ও একজন আনসার সদস্য করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন। কিন্তু রিপোর্ট আসার সময়টুকুতে ব্যাংকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছেন তারা। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও তাদের রিপোর্ট আসার আপ পর্যন্ত বাসায় আলাদা কক্ষে অবস্থান করা কিংবা আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়নি। তবে এখন তিনি সুস্থ থাকলেও তার ব্যাংকের আরও দুইজন আনসার সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
আরেক সংবাদকর্মী জানান, হঠাৎ করে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। কিন্তু রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। পরবর্তীতে তার স্ত্রীর শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়। কয়েকদিন পর আসা ওই রিপোর্টে করোনা পজিটিভ হন সংবাদকর্মীর স্ত্রী। কিন্তু রিপোর্ট আসার আগ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকার ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি তাদের।
মূলত নমুনা সংগ্রহ বুথে সামাজিক দূরত্বে বালাই না থাকা এবং রিপোর্ট প্রাপ্তিতে দীর্ঘ সময় লাগা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, যারাই নমুনা দিতে আসেন তাদেরকে ওই দিন থেকেই কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন মুক্ত করা হবে। এছাড়া নমুনা রিপোর্ট প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনারও দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বলেন, যারা নমুনা সংগ্রহ করেন- তারা বলে দেন আলাদাভাবে থাকার জন্য। কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো বলে না। আমরা গণসচেতনতা তৈরি করেছি। মিডিয়ার মাধ্যমেও বলছি, যত বেশি দূরত্ব বজায় রাখবে এবং ঘরে থাকবে তত নিরাপদ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় সারা দেশের নমুনা জমা হয়। সেজন্য দেরি হয়। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়ার জন্য তাগাদা দেই। আরেকটি বিষয় হলো- উপসর্গ নেই এবং আক্রান্তের সংস্পর্শে আসেনি; এমন অনেকেই সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্য নমুনা দেন। এতে করে আমাদের চাপ বেড়ে যাচ্ছে।
আজিজুল সঞ্চয়/এএম/পিআর