বাবার জন্য রোজ কাঁদে নিখোঁজ জেলের সন্তান

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি পটুয়াখালী
প্রকাশিত: ১১:৩৮ এএম, ২০ আগস্ট ২০২০

মা, বাবা কোথায়? বাবা আসো? বাবার ছবি দেখে আর বাবা বলে ডাকে। ছবি ধরতেই বাবার জন্য কেঁদে ওঠে দুই বছর বয়সী ছোট্ট কলি। তখন মায়ের কোনো সান্ত্বনা কলিকে থামাতে পারে না। দীর্ঘ ৯ মাস যাবৎ তার বাবার কোনো খোঁজ নেই।

কলির বাবার নাম সিপন হাওলাদার (২৫)। তিনি পেশায় একজন জেলে। ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন সিপন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ১২নং চম্পাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলে মো. রফিক হাওলাদারের ছেলে সিপন। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল ফরাজির মেয়ের মোসা. লামিয়া বেগমের সঙ্গে ২০১৭ সালে বিয়ে হয় সিপনের। বিয়ের একবছর পর ওই দম্পতির ঘর আলো করে আসে কলি।

সিপনের স্ত্রী লামিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী আজ ৯ মাস যাবৎ নিখোঁজ। তার জন্য আমার মেয়ে প্রতিদিন কাঁদে। বাবার ছবি দিলে সে খায় নয়তো খায় না। সকাল থেকে শুরু করে বাবা ডাক। ঘুমালে বাবা ডাক বন্ধ করে। কী যে কষ্ট বলে বুঝাতে পারব না।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ আমার স্বামীকে খুঁজে বের করে দিন। স্বামী যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিন, মরে গেলে লাশটা দিন।’

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর কলাপাড়ার ১২নং চম্পাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলে সিপন হাওলাদার (২৫) ও তার ভাই মো. আলম হাওলাদার (১৮), সঙ্গী মো. হাসান সিকদার (১৬), মো. মাফি (১৫) এবং মো. রায়হান (১৮) মাছ শিকার করার জন্য নৌকা নিয়ে রামনাবাদ চ্যানেলে যান। এরপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো খোঁজ না পেয়ে ১২নং চম্পাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রিন্টু তালুকদারের সুপারিশ নিয়ে কলাপাড়া থানায় যান সিপনের বাবা মো. রফিক হাওলাদার। নিখোঁজের বিষয়ে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর কলাপাড়া থানায় সাধারণ ডায়রি করেন।

Potuakhali

অপরদিকে একই এলাকার বাসিন্দা মৃত ইউসুফ সিকদারের একমাত্র ছেলে মো. হাসান সিকদার (১৬)। স্বামী হারা শাহিনুর বেগমের একমাত্র ছেলে মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে শোকে তিনি পাগলপ্রায়।

হাসানের মা বিধবা শাহিনুর বেগম বিলাপ করে বলেন, তার স্বামী মৃত্যুর সময় হাসানকে দুই বছর বয়সী রেখে যান। তিনি কষ্ট করে ছেলে বড় করেছেন। ছেলেকে কোনো কাজ করতে দেননি। সেই ছেলেকে ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর সিপনরা এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। সেদিন সিপনরা বলেছিল ৩ দিন সাগরে থাকবে তারা। অথচ আজ কত দিন হয়ে গেল।

তিনি আরও বলেন, তিনি ট্রলারের মালিক সিপনের পরিবারের কাছে তার ছেলের খোঁজ করতে গেলে তারা অসহযোগিতা করে। তিনি তার ছেলেকে জীবিত ফেরত চান।

অভিযোগ সম্পর্কে সিপনের চাচা মো. মনির হোসেন বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমাদের ছেলেরাসহ ৫ জন একটি বোর্ড (মাছের ট্রলার) নিয়ে বাড়ি থেকে সাগরে যায়। আমরা ১৯ ডিসেম্বর খবর পাই সাগরে ৫ জনসহ আমাদের বোর্ড মাইর পড়ছে (ডুবে গেছে)। এ সময় ট্রলার থেকে তিনটি মোবাইল, একটি ব্যাটারি, একটি পট উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী এলাকার জেলেরা।

তিনি আরও বলেন, ট্রলার মাইর পড়লে মোবাইল ও পট সাগরে ভাসতে পারে। কিন্তু একটা ব্যাটারির ওজন ৪৫ কেজি। সাগরের মধ্যে যদি বোর্ড মাইর পড়ে তাহলে ব্যাটারি পাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমাদের ছেলেরা বেঁচে আছে। যেই ট্রলারের লোকরা মালামাল পেয়েছে তাদের যদি প্রশাসন জিজ্ঞাসাবাদ করতো তবে পাঁচটি পরিবার তাদের নিখোঁজ সন্তাদের খুঁজে পেত।

তিনি আরও বলেন, সরকারের তরফ থেকে যদি ভারতে খোঁজ নেয়া যেত তাহলে ভালো হত।

পটুয়াখালী মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান নিতীমালা ২০১৯ পাস করেছে সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এ নিতীমালায় বলা হয়, নিহত জেলের পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের তালিকা প্রণয়ন করবে মৎস্য বিভাগ। প্রতি পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে পাবে।

পটুয়াখালী মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ্ বলেন, নিহত জেলের পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান নিতীমালা ২০১৯ পাস হওয়ার আগে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। তবে নিখোঁজ জেলে পরিবার থানায় যে সাধারণ ডায়রি করেছে সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এখানে উপজেলা মৎস্য অফিসার, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়নের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এই সহায়তা প্রদান করা হবে।

পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মইনুল হাসান বলেন, নিখোঁজ জেলের সন্ধান পেলে তাৎক্ষণিক তার তথ্য শনাক্তকরনে যে সকল পদক্ষেপ আছে তা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ওই সকল জেলেদের তাদের পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়।

মহিব্বুল্লাহ্ চৌধুরী/এফএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।