করোনা উপসর্গে মারা যাওয়া বাবার শেষ কথা মনে করে শুধু কাঁদেন মেয়ে
পাবনা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের গ্রাম ধোপাঘাটা। পাবনা-ঢাকা মহাসড়ক থেকে আরও তিন কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পাড়ি দিলে নূরুজ্জামান নূরু খানের বাড়ি। তিনি গত ২২ মে (শুক্রবার) করোনা উপসর্গে মারা যান। মৃত্যুর পর তার গোসল- জানাজা ও দাফন হচ্ছিল না। বাড়ির পাশে শত শত লোক ঘিরে ছিল যেন কেউ মৃতদেহ না ছুঁতে পারে। যে যাবে তাকেই একঘরে করে রাখা হবে। এ অবস্থায় মৃত নুরু খানের মৃতদেহ বিছানায় পড়েছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। তার মেয়েসহ নিকটাত্মীয়রা রাস্তায় বসে বিলাপ করছিলেন।
মৃত নূরুজ্জামান নূরু খানের বাবা মৃত রায়হান উদ্দিন খান। নূরু খানরা ৬ ভাই ও ৩ বোন। তার ২ মেয়ে ১ ছেলে। মেয়ে দু’জনের বিয়ে হয়েছে আর ছেলের বয়স মাত্র সাড়ে ৪ বছর। তিনি অসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য ছিলেন। অবসরের পর তিনি বাস চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
গত সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) ওই গ্রামে গিয়ে নূরু খানের স্বজন ও গ্রামবাসীর সঙ্গে এ সংবাদদাতার কথা হয়। তাদের কথায় উঠে আসে সেদিন নূরুজ্জামান নূরু খানের মৃতদেহ নিয়ে তার স্বজনরা কতটা অসহায় ছিলেন।
নূরুজ্জামান নূরু খানের মেয়ে লাভলী খাতুন বলেন, ‘আমার আব্বা করোনা উপসর্গে মারা গিয়েছিলেন বলে তার দাফনতো দূরের কথা কেউ গোসল করাতে আসেননি। তার মৃতদেহ বিছানায় পড়েছিল কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা। বাড়ির আশপাশে কয়েকশ লোক জড়ো হলেও তারা বাড়ির ভেতরে আসেননি। আমাদের বাড়ির ভেতরে আসতে সবাইকে বারণ করছিলেন গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকজন। এমনকি মসজিদের ইমামও আসতে চাননি। প্রশাসনের লোকজন অনুরোধ করলেও সেদিন গ্রামের কেউ কাছে আসেননি। তার কাফনের কাপড় কেউ এনে দেননি।
তিনি বলেন, পানি গরম করে গোসল করিয়েছিলেন দুই মহৎপ্রাণ যুবক দেওয়ান মাহবুব ও শিশির ইসলাম। দূর থেকে তাদের ইশারায় দেখিয়ে দিচ্ছিলেন ইমাম সাহেব। সেই দুই ভাই কাফনের কাপড় এনে তা পরিয়ে শেষে ইমাম সাহেবকে বুঝিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে জানাজা করান। তারাই দাফনের কাজ করেন। তাদের কথায় সাহস পেয়ে আমার এক চাচাত ভাই নাঈম খাঁনও সঙ্গে ছিলেন।
এখন অনেকেই বলেন, তাদের ভুল হয়েছিল। আমার নিজেরও অনেক ভুল ছিল। বার বার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কথাগুলো বলছিলেন মৃত নূরুজ্জামান নূরু খান এর মেয়ে লাভলী খাতুন।
ধোপাঘাটা গ্রামে করোনা উপসর্গে নূরু খাঁন মারা যাওয়ার পর এক করুণ পরিস্থিরি সৃষ্টি হয়। পরে অনেকেই তাদের ভুল বুঝতে পেরে গোসল ও দাফন করানো দু’যুবক মাহবুব ও শিশির ইসলামের কাছে তাদের ভুলের কথা স্বীকার করে ফোন করেছেন। অথচ সেদিন আতঙ্কিত গ্রামবাসী গোসল ও দাফন করানো এ দু’ যুবককে গ্রামের কোনো ভ্যানেও চড়তে দেননি। জনগণের সামনে পিপিই পুড়িয়ে দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে মহাসড়কে আসতে হয়েছিল তাদের।
নূরুজ্জামান নূরু খানের আপন ভাই নূহু খাঁন (৫৮) বলেন, তিনি নিজেও সেদিন অন্য সবার মতো আতঙ্কে ছিলেন। ধারণা ছিল মৃতদেহ ছুঁলেই তার করোনা হবে এবং সে মারা যাবে। প্রাণের ভয়ে সেদিন কেউ কাছে যেতে চায়নি।
গ্রামবাসী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সেসময় আমরা জানতাম করোনা রোগীর গোসল করালে তারও করোনা হতে পারে। তাই কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি।’
নূরু খানের ভাতিজা আশরাফুল ইসলাম বলেন, গ্রামবাসীসহ আত্নীয়-স্বজনরাও সেদিন ওই বাড়িতে যাননি। সেদিন আসলে কোনো ঘৃণা ছিল না। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওই বাড়িতে যাননি। প্রশাসনের লোকজন এসে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কারো আতঙ্ক কাটছিল না। কিন্তু গ্রামবাসীর ভুল ভেঙেছে।
মেয়ে লাভলী খাতুন আফসোস করে বলছিলেন- আমার বাবা রোগাক্রান্ত হওয়ার পর তাকে পৈত্রিক বাড়িতে ঠাঁই দেয়া হয়নি। সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। বাবার গ্রামেই আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি তাকে আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। বাবার জীবনের শেষ ৪টি দিন আমার বাড়িতে ছিলেন। পাড়া প্রতিবেশী সব সময় নজর রাখত আমার বাড়িতে কেউ এল কিনা!
তিনি বলেন- আমার বাবা বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আমিও স্বামী-সন্তান নিয়ে ভয়ে ছিলাম। তাকে ছোট একটি ঘরে প্রথমে আশ্রয় দিয়েছিলাম। মারা যাওয়ার আগের রাতে বাবা আমাকে বলেছিলেন ‘আজকের রাতটা একটু কাছে থাকো। তাও সাহস পাইনি।’
তিনি বলেন, র্যাব-পুলিশ যেমন আসামির বাড়ি ঘেরাও করে রাখে তেমনি আমার বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামবাসী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল। কেউ বাড়ির উপর এলেই তাকে একঘরে করে রাখার কথা বলা হয়।
নূরুজ্জামান নূরু খানের ভাতিজা নাঈম খাঁন বলেন, তার চাচা মারা যাওয়ার পর তার গোসল ও দাফন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এডওয়ার্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দেওয়ান আজিজুল ইসলাম স্যারের ছেলে স্বেচ্ছাসেবক মাহবুব ভাইয়ের কথা শুনেছিলাম। যিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাক্রান্তদের গোসল করান, জানাজা ও দাফনে অংশ নেন। তাকে খবর দিই। তিনি ও তার সহযোদ্ধা শিশির ইসলাম দ্রুত চলে আসেন। এসে আমাদের বিষয়টি বোঝান। পরে আমি নিজেও তাদের সঙ্গে দাফন-কাফনে অংশ নিই।
এমন মহতী কাজে অংশ নেয়া তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মাহবুব জানান, তিনি এ কাজটিকে একজন মুসলমানের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছেন। করোনা রোগী বা সন্দেহজনক রোগী মারা গেলে ভয়ে কেউ তার গোসল বা দাফনে অংশ নিতে চান না। অনেক জায়গাতেই এমনটি হয়েছে। নূরু খানেও ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছিল।
তিনি বলেন, ওই দিন ছিল শুক্রবার। দুপুর ১২টার দিকে তাকে জানানো হয়। শোনার সঙ্গে সঙ্গে সহযোগী শিশির ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে পিপিই পরে এবং অতিরিক্ত পিপিই নিয়ে সেখানে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন হাজার হাজার লোক বাড়ির আশপাশে। স্বজনরা রাস্তায় বসে বিলাপ করছেন। কিন্তু এলাকাবাসী কাউকে লাশের কাছে যেতে দিচ্ছেন না। প্রশাসনের লোকজন যাওয়ার পরও তাদের কথায় কেউ কাছে যাননি।
এরমধ্যে জুম্মার নামাজের সময় হওয়ায় মাহবুব ও তার সহযোগী শিশির পাশের মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ওই বাড়িতে আবার যান। তখন অন্তত ছয় ঘণ্টা মৃতদেহটি বিছানায় পড়ে ছিল। দেওয়ান মাহবুব এবং শিশির ইসলাম মৃতদেহ ঘর থেকে বের করেন ও তার গোসল সম্পন্ন করেন। তারা মসজিদের ইমামকে বোঝান, গ্রামবাসীকে বোঝান। এরপর ইমাম দূর থেকে তাদের ইশারায় সব বুঝিয়ে দেন এবং তারা গোসল সম্পন্ন করেন। তখন মৃতের ভাতিজা নাঈম খাঁন ভরসা পান ও দাফন কাফনে তাদের সঙ্গে অংশ নেন। পরে মৃতদেহের জানাজা সম্পন্ন করেন।
দেওয়ান মাহবুব জানান, নুরু খাঁন মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর তিনি ও শিশির ইসলাম ওই গ্রামে আবার যান। মৃতের কবর জিয়ারত করেন। গ্রামবাসীকে তারা বোঝান যে তারা এখনও আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছেন।
মাহবুব জানান, যারা সেদিন অমানবিক আচরণ করেছিলেন তাদের অনেকেই পরে তার কাছে মোবাইল ফোনে বা সরাসরি দুঃখ পকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে গয়েশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মুতাই জানান, নূরু খাঁন মারা যাওয়ার পরই তিনি খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। আসলে কয়েক মাস আগে অন্যান্য স্থানের মতো এ গ্রামের লোকজনও করোনা রোগীর গোসল বা জানাজা দিতে ভয়ে ছিলেন। গ্রামের লোকের মধ্যে এখন সেই আতংক নেই। আল্লাহর রহমতে ওই গ্রামে কেউ আর আক্রান্ত হননি।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম আহমেদ জানান, পাবনায় যেখানেই করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেছেন সেখানেই পুলিশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক মৃতদেহ সৎকারে সহযোগিতা করেছে।
পাবনার সিভিল সার্জন ডা. মেহেদী ইকবাল জানান, করোনা থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো অনেকেই সেটা মানছেন না। আবার মারা গেলে অহেতুক আতঙ্কও ছড়ান অনেকে। করোনায় কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গোসল বা দাফন-কাফন করানো যাবে।এটা শুধুই মনের ভয়। কারণ মানুষ মারা যাওয়ার পর জীবানু বাঁচে না।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পাবনার উপ-পরিচালক ইমামুল ইসলাম জানান, মানুষ মারা যাওয়ার পর যার যার নিজস্ব ধর্মী নিয়ম অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে পাবনায় করোনা সংকটের শুরু থেকেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছেন। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ১৯টি মৃতদেহ ইফার স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় দাফন-কাফন করা হয়েছে।
পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, করোনায় বা করোনা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জেলা প্রশাসন বা উজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ মহতী কাজ করে আসছে। তাই কোনো মৃতদেহের সৎকার হয়নি পাবনায় এমন উদাহরণ নেই।
এফএ/জেআইএম