চাটমোহরের অনন্য স্বাদের ‘কুমড়ার বড়ি’ যাচ্ছে বিদেশে
>> চাল আর কুমড়ার মিশ্রণে তৈরি হয় অনন্য স্বাদের ‘কুমড়ার বড়ি’
>> রসনা বিলাসে দেশের বাইরেও যাচ্ছে
>> মাসকলাই দিয়ে তৈরি বড়ির চাহিদাই বেশি
পাবনার চাটমোহর উপজেলার দুই শতাধিক দরিদ্র পরিবার কুমড়ার বড়ি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। অর্ধশত বছরের এ ঐতিহ্য এখন গৃহস্থের বাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিকভাবেও উৎপাদন হচ্ছে। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে কুমড়ার বড়ি তৈরির কাজ। অনন্য স্বাদের এ কুমড়ার বড়ি তৈরি হয় ডাল আর কুমড়ার মিশ্রণে।
হরেক রকম ডাল দিয়ে এ বড়ি তৈরি হলেও অ্যাংকর ও মাসকলাই ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহসহ বিদেশেও যাচ্ছে চাটমোহরের কুমড়ার বড়ি।
চাটমোহর পৌর সদরে অর্ধশতাধিক পরিবার কুমড়ার বড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া উপজেলার দোলং, বোথর, মথুরাপুর, বালুচর, রামনগরসহ বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে দুই শতাধিক পরিবার কুমড়ার বড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ পরিবারগুলো শীত মৌসুমের পুরোটাই কুমড়ার বড়ি উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাড়ির নারীরাই মূলত এ বড়ি তৈরি করেন। পুরুষরা বাজারজাত করেন। এতে তারা মৌসুমে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।

চাটমোহর পৌর এলাকার দোলং গ্রামের কুমড়া বড়ি উৎপাদনকারী ঊষা রানী ভৌমিক বলেন, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। একটা সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আগে সারাদিন ডাল ভিজিয়ে রেখে শিল-পাটা দিয়ে বেটে বড়ি দিতে হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। এখন শিল-পাটায় বাটার বদলে ডাল মেশিন দিয়ে ভাঙানো হয়। এতেআমাদের খাটনি কমেছে ও সময় বেঁচে যাচ্ছে। এতে এখন বেশি বড়ি তৈরি করতে পারছি।’
দোলং গ্রামের সুদীপ দাস ও মায়ারানী জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত ডাল ভিজিয়ে মেশিনে গুঁড়া করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে বড় গামলা বা বালতিতে ডালের গুঁড়া, পাকা চালকুমড়া, কালোজিরা, গোলমরিচ এবং মসলা মিশিয়ে সুস্বাদু কুমড়ার বড়ি তৈরি করা হয়।
এরপর টিনের বা কাঠের পিঁড়িতে সরিষার তেল মাখিয়ে কাপড়ের সাহায্যে জিলাপি তৈরির মতো বড়ি করে সাজিয়ে শুকাতে দেয়া হয়। ৩-৪ দিন কড়া রোদে শুকালে প্রস্তুত হয় সুস্বাদু কুমড়ার বড়ি। এ কাজগুলো নারীরাই করেন।
কুমড়ার বড়ি বিক্রেতা সুনীল সরকার ও প্রদীপ ভৌমিক বলেন, ‘আকারভেদে প্রতিটি পাকা চালকুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনতে হয়। খেসারি ডাল ৮৫-৯০ টাকা, অ্যাংকর ৪০ এবং মাসকলাই ১২০ টাকা দরে কিনতে হয়। প্রতি কেজি ডাল থেকে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম বড়ি তৈরি হয়। বাজারে ডালভেদে ১০০-১৫০ টাকা কেজি দরে কুমড়ার বড়ি বিক্রি হয়। অ্যাংকর ও মাসকলাই ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি।খুচরা বাজারে ডালের বড়ি চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়।’

তারা আরও বলেন, চাটমোহরের উৎপাদিত কুমড়ার বড়ি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর হয়ে এখন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা চাটমোহরে আসেন কুমড়ার বড়ি কিনতে। পাইকারি দাম কিছুটা কম। এছাড়া অর্ডার দিয়ে বানালে খরচটা আরও বেশি পড়ে। তারা জানান, শিল-পাটায় বাটা ডালের তৈরি বড়ির কদর সবসময় একটু বেশি থাকে।
এদিকে আত্মীয়-স্বজনদের হাতঘুরে কুমড়ার বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালিদের রসনা তৃপ্ত করছে। এ অঞ্চলের মানুষ যারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচিতি পাচ্ছে এ সুস্বাদু তরকারি।
কুমড়ার বড়ি উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন গড়ে প্রতিদিন ২০ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করতে পারেন। বাড়ির দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে নারীদের পক্ষে এটা করা সম্ভব। কারণ ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টার মধ্যে বড়ি তৈরি বা রোদে দেয়ার কাজ শেষ হয়। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কুমড়ার বড়ির ভালো ব্যবসা চলে। এ মৌসুমে ব্যবসা করে সংসারে বাড়তি আয় করে বহু পরিবার দারিদ্র্য দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ জীবিকা নির্বাহ করেন এই বড়ির ওপর ভিত্তি করে। পৌর সদরের শাহী সমজিদ এলাকা ও দোলং গ্রামের গ্রামের চাপারানী (২৮), উত্তম মহ (৪২), হাবুল (৪৭), শাহজাহান (৩৩), স্বপ্না (৩২), মালতী (৩৬) মায়ারানী (৪৮), সীমাসহ (২৮) শতাধিক পরিবার এই কুমড়ার বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন।

স্থানীয়রা জানান, বড়ি তৈরিতে চাল কুমড়ার সঙ্গে ডালের যেমন নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রান্নার সময় কুমড়ার বড়ির সঙ্গে মিঠাপানির মাছ থাকলে তা অনন্য হয়ে ওঠে। এই কুমড়ার বড়ি যেকোনো ঝোলের মাছের তরকারি হিসেবে ব্যবার হয়। চলনবিলের দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, শৈল, আইড়, গজারসহ মাছের তরকারি রান্নায় স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে ব্যবহার করা হয় এই কুমড়ার বড়ি। অনেকে নিরামিষ তৈরিতে ডাল মেশান।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শাসছুর রহমান জানান, চলনবিল এলাকায় কুমড়া ও ডালের যেমন প্রাচুর্য রয়েছে তেমনি এখানে আছে বড়ি তৈরির দক্ষ কারিগর। ফলে এ কুটির শিল্পটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে।
পাবনা বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রফিকুল ইসলাম জানান, পাবনার চাটমোহরের কুমড়া-বড়ি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প। এ শিল্পে চাটমোহরের কয়েকশ মানুষ বাড়তি আয় করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। এ শিল্পে খুব একটা পুঁজি লাগে না। ঋণের জন্য কেউ আসেন না। কেউ এজন্য সহযোগিতা চাইলে তাদের জন্য দরজা খোলা রয়েছে।
আমিন ইসলাম/এসআর/পিআর