মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সুলতান মাঝি, সনদ বাগিয়েছেন সুলতান দুয়ারী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০৯:৩৬ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০

ঝালকাঠি সদর উপজেলার পিপলিতা গ্রামের মৃত সৈয়জদ্দিনের ছেলে সুলতান হোসেন মাঝি। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেলও আতাউল গণি ওসমানীর দেয়া সনদ পান তিনি। লেখাপড়া না জানলেও সুলতান মাঝি সযত্নে তুলে রেখেছিলেন সনদটি।

মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে ভাতা দেয়ার নাম করে তার কাছ থেকে সনদটি নেন পাশের গ্রামের নেহালপুরের মৃত সৈয়দ আলী দুয়ারীর ছেলে সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী। তবে ভাতা দূরে থাক, সনদই আর ফেরত পাননি সুলতান মাঝি। প্রভাবশালী হওয়ায় এনিয়ে সুলতান দুয়ারীর সাথে জোরাজুরিও করেননি সুলতান মাঝি।

স্থানীয়দের কাছে ‘চতুর’ হিসেবে পরিচিত সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী এরই মধ্যে সনদটি নিজের করে নেন। বিভিন্ন অফিসে দৌঁড়ঝাপ করে ‘বাবার নাম ভুল’ দাবি করে ‘সংশোধন’ করে নেন সনদটি। সুলতান মাঝির বাবার নাম (মৃত সৈয়জদ্দিন) সরিয়ে সেখানে যুক্ত করে নেন নিজের বাবার নাম (মৃত সৈয়দ আলী দুয়ারী)। তাতেই বাজিমাত! যুদ্ধে অংশ না নিয়েই রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যান সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী।

এরপর একের পর এক সরকারি সকল সুবিধা বাগিয়ে নেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সন্তানদের চাকরি থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা ভোগ করছিলেন সুলতান দুয়ারী। তবে সম্প্রতি এনিয়ে সরব হয় সুলতান মাঝি ও তার পরিবার। তাদেরকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। বিষয়টি নিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) লিখিত অভিযোগ করেন তারা।

বিষয়টি তদন্ত করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেন প্রশাসন। তাতেই উঠে আসে সুলতান দুয়ারীর প্রতারণার চিত্র। এর প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৪৮তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৈয়দ আলী দুয়ারীর ছেলে ‘সুলতান হোসেন দুয়ারীর’ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয়।

গত ২২ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রথীন্দ্রনাথ দত্ত স্বাক্ষরিত আদেশের চিঠি ১ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সদর উপজেলার ইউএনও সাবেকুন নাহারের কাছে পৌঁছে। এরপর ইউএনও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সুলতান দুয়ারির সনদ বাতিল হওয়ায় খুশি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাঝির স্ত্রী ও সন্তানেরা। ২০১৯ সালে তদন্ত চলাকালে মারা যান সুলতান মাঝি। সন্তানদের আক্ষেপ তাদের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্বেও স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেননি। তাদের দাবি- দ্রুত সুলতান হোসেন মাঝির নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

সুলতান মাঝির স্ত্রী ফরিদা বেগম বলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমি অসহায় জীবনযাপন করছি। স্বামীর মৃত্যুর পর আমরা অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। দ্রুত আমার স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যুক্ত করা হোক।

সুলতান দুয়ারীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল হওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। দুয়ারীর আপন চাচা ৯১ বছর বয়সী আকরাম আলী দুয়ারী বলেন, সুলতান আহম্মেদ দুয়ারী আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে আমাদের সাথে বাড়িতেই ছিল। ওর বয়স তখন ১৭ থেকে ১৮ বছর হবে। ও মুক্তিযুদ্ধ করেনি। সুলতান মাঝির ‘ওসমানী সনদ’ নিয়ে নিজের নাম বসিয়ে নিয়েছে।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সুলতান দুয়ারীর বাল্যবন্ধ আবদুল হক তালুকদারও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। তিনি বলেন, দুয়ারী আমার থেকে এক বছরের বড়। ছোটবেলায় আমরা একসাথে খেলাধুলা করতাম। ও মুক্তিযুদ্ধে গেছে বিষয়টি কখনও জানি না। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। বিষয়টি খুবই খারাপ হয়েছে।

এদিকে গেজেট বাতিল হলেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সুলতান দুয়ারী থেমে নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাঝির স্ত্রী-সন্তানদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন তিনি। স্থানীয় ব্যক্তিরা যারাই তার মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেয়ার তথ্য দিচ্ছেন তাদেরকেও দেখে নেয়ার হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন দুয়ারী।

সম্প্রতি তিনি অস্বচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ আবাসন পেতে ফরম পূরণ করেছেন। অথচ তার ছাদের বাড়ি রয়েছে। কৌশলে তিনি বাড়ির ভবনের পাশের পুরনো বাড়িটি নিজের দেখিয়ে আবেদন করেছেন। বিষয়টি এখন তদন্ত করছে উপজেলা প্রশাসন। সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ইউএনও।

আতিকুর রহমান/এএএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।