জীবদ্দশায়ই ‘ঠাটারি’ পেশার বিলুপ্তি দেখলেন ইয়াদ আলী

জীবনের প্রায় ৮০ বছর ‘ঠাটারি’(তৈজসপত্র মেরামতকারী) পেশায় কেটেছে ইয়াদ আলীর। তাই আসল নাম আড়ালেই চলে গেছে, পেশার নামটিই জীবনের সঙ্গে গেঁথে গেছে তার। এলাকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ‘ঠাটারি’ নামেই পরিচিত।
১১০ বছর বয়সী এ মানুষটি গত দুই বছর ধরে চোখে দেখেন না। অদক্ষ এক চোখের ডাক্তারের হাত তার ক্ষীণদৃষ্টিকে একেবারে অন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বন্ধ রয়েছে তার হাতুড়িসহ কিছু ভাঙা বাতি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরা। হাতুড়ে ডাক্তারের কারণে চোখের আলো যেমন নিভে গেছে, তেমনি বিলুপ্ত হলো পেশাটাও।
ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র একটি পেশায় সম্ভবত তিনিই দীর্ঘতম সময় ধরে নিয়োজিত ছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এ প্রবীণের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার রসুলপুর গ্রামে। তার জীবনাবসান হলে ‘ঠাটারি’ নামটিও হয়তো মুছে যাবে এলাকা থেকে।
কয়েকদিন আগে রসুলপুর গ্রামে তার সঙ্গে কথা হয়। ‘ঠাটারির বাড়ি কোনটি’ বলতেই ছোটবড় সবাই দেখিয়ে দিলেন। দেশখ্যাত পেঁয়াজের হাট বনগ্রাম বাজারের পাশে ছবির মতোই রসুলপুর গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা আত্রাই নদী (এখন পাবনা সেচ প্রকল্পর মূল ক্যানাল)। শনি-মঙ্গলবার গ্রামে হাটও বসে। সে গ্রামেরই এক ধারে তার বাড়ি।
জাগো নিউজ কথা বলে ইয়াদ আলী ও তার পরিবারের সঙ্গে। এর আগে ২০ বছর আগে যখন তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল, তখন তিনি ঠাটারির কাজ কম হলেও কিছুটা পেতেন। এরপর ধীরে ধীরে কাজ কমে আসতে থাকে। কাজ না করালেও এ গ্রামে সে গ্রামে গেলে পুরাতন পেশার মানুষ হিসেবে গ্রামের লোকেরা তাকে ভালোবেসে টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল দিতেন।
দীর্ঘজীবন কাজ করে খাওয়া আজকের অন্ধ প্রবীণ ইয়াদ আলী মৃদুস্বরে জানান, দাড়ি-মোচ গজানোর আগে থেকেই করতেন ঠাটারির কাজ। একটানা প্রায় ৮০ বছর করেছেন। দুই দশক আগেও মানুষ টিনের প্লেট, পাতিল, হারিকেন, বাতিসহ কতকিছু জোড়াতালি দিয়ে চালাতেন। হরেক রকম বাতি, সিসা সবই থাকত তার কাছে। টিনের প্লেট ‘ফুটা’ (ছিদ্র) হলে মানুষ সেসব মেরামত করিয়ে নিতেন। অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল, জগ বা টিনের বালতি নষ্ট হলে মেরামত করে দিতেন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন।
মানুষের নাম ধরে ধরে জানালেন, কত শত মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আজ তাদের অনেকেই পৃথিবীতে নেই। বছর দুয়েক আগে তেমন কাজ না থাকলেও গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন।
দুই বছর আগে চোখের সমস্যায় এক হাতুড়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন ইয়াদ আলী। তিনি তার চোখের ছানি তুলে দেয়ার কথা বলেন। ঠাটারি ইয়াদ আলী বলেন, চোখে যা একটু দেখতাম তারপর থেকে একেবারে অন্ধ হয়ে গেছি। এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া বাইরেও যেতে পারি না। ঝুপড়ি ঘরের ছোট এক চিলতে বারান্দায় একটা জলচৌকিতে বসেই দিন কাটে। বললেন- ‘নামাজ-কালাম পড়ি আর আল্লাহ আল্লাহ করি।’
সংসার জীবনের শুরুতে তার পেশায় এমন দুর্দিন ছিল না- জানালেন এই অশীতিপর বৃদ্ধ। এ পেশা ধরে রেখেই দুই ছেলে ও চার মেয়েকে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন।
ইয়াদ আলীর স্ত্রী অজিরন খাতুনও বললেন সে কথা। আগের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের (আয়ুব খানের আমলে বিয়ে) বয়সও ৬০ বছরের মতো।
তিনি জানান, আগে ভেবেছিলাম বাপ-মা কার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন! ঠাটারি কী তার ভাত-কাপড় দিতে পারবে? বলেন, ‘বিয়ের পর দেখি, ঠাটারির ভালো আয়। মানুষ টাকা-পয়সা দিত, ফল-ফসলাদি দিত, রান্না করা খাবার পর্যন্ত দিত।’ তখন সংশয় কাটে বলে জানান অজিরন খাতুন।
তিনি আরও জানান, প্রায় ২০ বছর আগে থেকেই আয় কমতে থাকে। কারণ মানুষের বাড়ি বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে। তৈজসপত্রে প্লাস্টিক বাজার দখল করে। মানুষ জোড়াতালির প্লেট-পাতিলে উৎসাহ হারাতে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের কোনো ছেলে এ কাজ শেখেওনি যে পেশাটি ধরে রাখবে। আর শিখলেও কাজ তো পেত না, ভাত পেত না।’
এলাকার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইয়াদ আলী ঠাটারির মতো বেশি বয়সী মানুষ পাবনায় কয়জন আছে তা জানা নেই।
৭০ বছরের বৃদ্ধ আফসার আলী জানান, তারা ছোটবেল থেকে ঠাটারিকে গ্রামে গ্রামে কাজ করতে দেখেছেন। একশ বছরের ওপর বয়স তার। এখন তিনি চলাচলও করতে পারেন না।
রসুলপুর গ্রামের সিদ্দিক নামে তার এক আত্মীয় জানান, তিনি (ইয়াদ আলী) ছাড়া পাবনা জেলায় কোনো ঠাটারি আছে বলে জানা নেই।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মানবাধিকার কর্মী সহকারী অধ্যাপক ড. শাহনাজ পারভীন জানান, এখন মানুষের সংসারের জিনিসপত্র বদলে গেছে। ঠাটারির প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেন না। করলেও হাতের কাছে আর পান না। এ পেশার মানুষ যেহেতু আর নেই, তাই ইয়াদ আলীর মধ্য দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে ঠাটারি পেশাটি।
পাবনার বেড়া উপজেলার মনজুর কাদের মহিলা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. আশরাফ পিন্টু জানান, গবেষণা কাজে তিনি পাবনার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরেছেন। গ্রামে গ্রামে হরেক রকম পেশাজীবী, বিলীয়মান পেশাজীবী মানুষের সন্ধান পেলেও ঠাটারি পেশার মানুষ খুঁজে পাননি। এ জেলা থেকে পেশাটি বিলুপ্তই হয়ে গেল বলা যায়।
সাঁথিয়া উপজেলার মানবাধিকার কর্মী ও সহকারী অধ্যাপক ড. শাহনাজ পারভীন বলেন, এখন সংসারের জিনিসপত্র বদলে গেছে। ফলে ঠাটারির প্রয়োজনিয়তা কেউ অনুভব করে না। করলেও হাতের কাছে আর পায় না। এ পেশার মানুষ যেহেতু আর নেই, তাই ইয়াদ আলীর মধ্য দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে ঠাটারি পেশাটি।
বেড়া উপজেলার মনজুর কাদের মহিলা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. আশরাফ পিন্টু জানান, গ্রামে গ্রামে হরেক রকম পেশাজীবী, বিলীয়মান পেশাজীবী মানুষের সন্ধান পেলেও ঠাটারি খুঁজে পাননি। এ জেলা থেকে পেশাটি বিলুপ্তই হয়ে গেছে বলা যায়।
সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এস এম জামালা আহমেদ জানান, ছোটবেলায় ঠাটারি পেশার মানুষ দেখেছেন। তবে মানুষের জীবনযাত্রা বদলের সঙ্গে সঙ্গে পেশাটিও বিলুপ্ত হচ্ছে। এ পেশায় জড়িত ছিলেন এমন একজন মানুষ সাঁথিয়ায় রয়েছেন। তিনি এখন অসুস্থ। একটি ঐতিহ্যবাহী পেশার শতবর্ষী মানুষ হিসেবে তিনি দেশের মূল্যবান সম্পদ।
আমিন ইসলাম/এসআর/এমএস