ঈদকে ঘিরে উৎপাদিত কাপড় অবিক্রীত, দিশেহারা তাঁত মালিকরা
সুতা ও রংসহ সরঞ্জামাদির দাম বৃদ্ধির মধ্যেও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে কাপড় তৈরি করেছেন সিরাজগঞ্জের তাঁত মালিকরা। কিন্তু করোনা রোধে চলমান লকডাউনে হাটে হাটে কাপড় পরিবহন বন্ধ রয়েছে। কাপড় কিনতে আসছেন না পাইকাররাও। এতে উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁত মালিকরা।
ফলে অর্থসঙ্কটে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ছেন তাঁত শ্রমিকরা। তাঁত শিল্পের সাফল্য ধরে রাখতে বর্তমান ও অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আশা করছেন মালিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষে বাহারি সুতি কাতান, ফেরুয়া কাতান, মিক্স সিল্ক, লালপরি, ভাগ্যলক্ষ্মী, রাধা, যশোরী শাড়ি তৈরি করেছেন তাঁতিরা। এরই মধ্যে ২১ রোজা শেষ হয়েছে। চাঁদ দেখা অনুযায়ী ঈদের মাত্র আর বাকি ৯-১০ দিন। কিন্তু লকডাউনে সাপ্তাহিক কাপড়ের হাটগুলোতে ক্রেতা আসতে না পারায় অবিক্রীত রয়ে যাচ্ছে এসব কাপড়।
তাঁতিদের বাড়িতে পর্যাপ্ত কাপড় মজুত থাকলেও বিক্রি করতে না পারায় শ্রমিক বিল, মহাজনের ঋণ আর ব্যাংক লোন পরিশোধ নিয়ে চিন্তিত তাঁত মালিকরা। এই শিল্পের দুরবস্থায় লাখ লাখ শ্রমিক বেকার আতঙ্কে ভুগছে। ঋণের জালে জর্জরিত তাঁত মালিকরা পালিয়ে বেড়ালেও নিলাম থেকে মুক্তি পাচ্ছে না তাঁত কারখানাসহ বসতবাড়ি।
তামাই এলাকার তাঁত শ্রমিক হযরত আলী, মোতালেব হোসেন ও শুকুর মাহমুদ বলেন, ‘গত বছরের ক্ষতি এবার পুষিয়ে নিতে চাইলেও লকডাউনের কারণে মহাজনরা কাপড় বিক্রি করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে দিনদিন কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আমরাও কর্মহীন হয়ে বিপদে পড়ে যাচ্ছি। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি প্রণোদনাসহ নানা প্রকার সহযোগিতা দরকার।’
তাঁতকুঞ্জ সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প বাঁচাতে সরকার প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেয়াসহ অবিক্রীত তাঁতপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা না নিলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের রুটি-রুজির এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানালেন সিরাজগঞ্জের জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বেলকুচি উপজেলা হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক হাজি মেজবাহ বলেন, ‘রোজা ও ঈদের আগে চলমান লকডাউনে তাঁত মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় হাটে পাইকাররা আসতে পারছে না। এ কারণে উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুণতে হচ্ছে। এতে শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ছে। সরকার সহযোগিতা না করলে একে একে বন্ধ হয়ে যাবে তাঁত কারখানা।’
সিরাজগঞ্জ তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাকী বলেন, ‘সরকারের সঠিক নজরদারি না থাকায় আজ এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জেলা প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত কাপড়ের হাট ও কাপড় পরিবহন খুলে না দিলে তাঁতিদের বাঁচার পথ থাকবে না।
বেলকুচি পৌরসভার মেয়র সাজ্জাদুল হক রেজা বলেন, ‘শুধু তাঁত শিল্প বেলকুচি না, পুরো সিরাজগঞ্জ জেলা তাঁতশিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত। করোনার সময়ে প্রথম ধাপে বেলকুচির তাঁত শ্রমিক ও মালিকদেরকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। যারা প্রকৃত তাঁতি তারা যেন সরকারি প্রণোদনা পায় এ বিষয়ে বেলকুচি পৌরসভার পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’
বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনিছুর রহমার বলেন, ‘তাঁতকুঞ্জ হিসেবে সিরাজগঞ্জকে ঘোষণা করা হয়েছে। করোনায় প্রথম পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁত মালিকদের জেলা প্রশাসন থেকে অনুদান দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত তাঁত শ্রমিক ও মালিকদের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লকডাউনে ভারতের কাপড় এখন দেশে আসার আর কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে যেন ভারতের কাপড় বাজারজাত না করতে পারে। কাপড় পরিবহনের গাড়ি চলাচলে কোনো বাঁধা দেয়া হচ্ছে না। তবে যাত্রী পরিবহন বন্ধ রয়েছে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়নি। সম্প্রতি সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সম্মিলিতভাবে সবাই চেষ্টা করলেও আবার সুতার দাম কমে আসবে।’
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য্য বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিরাজগঞ্জ জেলাকে তাঁতকুঞ্জ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এখানে অনেক তাঁতশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের বাইরেও রফতানি হয়। এই শিল্পের সঙ্গে তিন লাখ শ্রমিক জড়িত রয়েছে। প্রথম দফা করোনাভাইরাসের সময় যে কাপড় তৈরি করেছিল, তাও বিক্রি করতে পারেনি তাঁত মালিকেরা। করোনা মহামারির কারণে এবারও একই অবস্থা। হাটবাজার, দোকানপাট বন্ধ থাকায় তাঁতশিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।’
ইউসুফ দেওয়ান রাজু/এসজে/এমকেএইচ