নিজ এলাকায় কোয়ারেন্টাইন চান ভারতফেরত যাত্রীরা
খুলনার ডুমুরিয়া এলাকার সুমন সরকার ভারত গিয়েছিলেন পায়ের রানের হাড়ের সংযোগস্থলে অস্ত্রোপচার করাতে। চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার আগেই সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরে এখন যশোরের ম্যাগপাই হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
ক্র্যাচে ভর দিয়ে সুমন সরকার জানান, ভারতে চিকিৎসায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। চিকিৎসায় সব টাকা শেষ করে দেশে এসে হোটেলে খরচ করার মতো সঙ্গতি নেই। আবার ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে বলে দুর্ভোগও রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে এসে আর্থিক এবং শারীরিক দু’ভাবেই তিনি বিপর্যস্ত।
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন এলাকার বর্ণা আক্তার তার পাঁচ বছরের অটিস্টিক শিশুকে ভারতে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। অটিস্টিক শিশুকে সামলানো কঠিন বিধায় স্বামীসহ পরিবারের ছয় সদস্য গিয়েছিলেন সেখানে। এখন দেশে ফিরে এসে হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করতে হচ্ছে। ছয় সদস্যের হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচ চালানো নিয়ে তিনি দুুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
শুধু সুমন সরকার বা বর্ণা আক্তারই নয়; যশোরে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা ভারতফেরত পাসপোর্টধারী যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্র কমবেশি এমনই। তাই তারা নিজ এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করতে চান। প্রশাসন বলছে, করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) রুখতে তারা সব ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে ব্যাপক হারে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ভারতে আটকা পড়েন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী। তাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপ-হাইকমিশন থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে। দেশে ফেরার পর তাদের থাকতে হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে। প্রথমে বেনাপোলে রাখা হলেও পরে যশোরের ২৯টি হোটেলে এই কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, গত ২৬ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত বেনাপোল দিয়ে দেশে ফিরেছেন দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ। যশোর ও বেনাপোলের ২৯টি হোটেল ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই পাসপোর্টযাত্রীদের। কিন্তু শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভারতে চিকিৎসা শেষে ফেরা এ মানুষগুলো কোয়ারেন্টাইনে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। পাশাপাশি অসুস্থরা চিকিৎসা সঙ্কটেও রয়েছেন। এজন্য তারা চাচ্ছেন তাদেরকে যশোরে না রেখে নিজ এলাকায় কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হোক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের গোলাম জীবন কাদের বিশ্বাস ও তার মা রহিমা বেগম বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে ফিরেছেন ২৮ এপ্রিল। নিয়ম অনুযায়ী তাদের হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছে। কিডনি রোগী কাদের বিশ্বাসের খাবারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বিধিনিষেধ দিয়েছেন। সয়াবিন তেলের কোনো খাবার তিনি খেতে পারবেন না। আর তার মা রহিমা বেগম হার্টের রোগী হওয়ায় তারও চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকা দরকার। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে এসে এসবের কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে, হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের সেবা দিতে গিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন আবাসিক হোটেলের কর্মীরাও। যশোর ম্যাগপাই হোটেলের ব্যবস্থাপক আশিকুজ্জামান জানালেন, তাদের হোটেলে ২৭ জন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ভারতফেরত এই ব্যক্তিদের তারা শুধু মাস্ক পরেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অন্য কোনো স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোটেলের একজন কর্মকর্তা জানালেন, করোনা বিধিনিষেধ-লকডাউনের কারণে এমনিতেই হোটেল ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে। এর ওপর হোটেলে কোয়ারেন্টাইনের জন্য ভারতফেরতদের রাখায় সাধারণ মানুষ আর হোটেলমুখো হচ্ছেন না।
যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, ২৬ এপ্রিলের পর ভারত থেকে যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। এদের মধ্যে যারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদেরকে হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। বাকিরা হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এছাড়া এপ্রিল মাসে বেনাপোল দিয়ে ৩৫ জন করোনা রোগী দেশে ফিরেছেন। তাদের সবাইকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক ও জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক মো. তমিজুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ রোধে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। পাশাপাশি তারা কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও দেখছেন।
তিনি আরও বলেন, যেসব স্থানে ভারতফেরত যাত্রীদের রাখা হয়েছে সেসব স্থানে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের মেডিকেল টিম সেখানে যাচ্ছে এবং তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে। ১৪ দিন অবস্থানের পর করোনা নেগেটিভ সনদপ্রাপ্তি সাপেক্ষে এসব যাত্রীদের নিজ বাড়ির উদ্দেশে যেতে দেয়া হবে।
‘ভারত থেকে যে সংখ্যক পাসপোর্টযাত্রী ফেরত আসার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি যাত্রী ফেরত আসায় জেলার কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ফেরত আসা যাত্রীদের খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলে পাঠানো হচ্ছে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাদের এখানে স্থলবন্দর আছে। এখান থেকে ভারতে লোকজন যাওয়া-আসা করে। কাজেই এই এলাকাটা, বিশেষ করে ভারতের সেই ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ রুখতে প্রশাসন সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মিলন রহমান/এসআর/জেআইএম