সুগন্ধা-বিষখালীর ভাঙন হুমকিতে স্কুলসহ শতাধিক স্থাপনা-প্রতিষ্ঠান

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০৪:২৬ পিএম, ০৭ আগস্ট ২০২১

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ঝালকাঠির বিষখালী নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র, মসজিদ, বাজারসহ শত শত হেক্টর কৃষিজমি। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও বেশকিছু স্থাপনা। আকস্মিক ভাঙনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ভাঙনে হুমকির মুখে বাসস্ট্যান্ড, সাইক্লোন শেল্টার, বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, সড়কসহ প্রায় ২০টি গ্রাম। এরই মধ্যে এ ভাঙনে বিলীন হয়েছে জেলার অর্ধশত গ্রাম। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে এ ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় ভাঙনের মাত্রা বেড়েই চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব ভাঙন প্রতিরোধে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠালেও তা ফাইলবন্দি হয়ে আছে বলে জানা গেছে।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে কৃষ্ণকাঠি বাসস্ট্যান্ড ও কুতুবনগর মাদরাসাসহ এলাকার বসতবাড়ি। এর আগে এ এলাকায় এক রাতে আকস্মিক ভাঙনে তলিয়ে গেছে বসতবাড়িসহ গাছপালা। একইভাবে জেলা শহরের একমাত্র বাসস্ট্যান্ডটি যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হওয়ার পথে।

jagonews24

সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের পোনাবালিয়া, দেউরি, আতাকাঠি, দিয়াকুল, মানকি, ভাওতিতাসহ কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি বিষখালী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রামের প্রায় দেড় হাজার একর আবাদি জমি নদীতে ভেঙে যাওয়ায় শত শত কৃষক বেকার হয়ে পড়েছেন।

পশ্চিম দেউরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারুক হোসেন জানান, নদী তীরের বেড়িবাঁধটি না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। এ ইউনিয়নের সাইক্লোন শেল্টারের পিলার এখন নদীর ভেতরে। ব্লক ফেলে বিষখালী নদীর এই ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে।

নলছিটি পৌরসভার মল্লিকপুর থেকে সারদল গ্রাম পর্যন্ত সুগন্ধা নদীর তীব্র ভাঙন আরও তীব্রতর হচ্ছে। নলছিটির হদুয়া এলাকার বাসিন্দা কাসেম সিকদার বলেন, ‘জায়গা-জমি বহু আগেই গেছে। গতবছর বাড়ি গেছে, এবার দোকানটাও গেল। এখন আমার আর কিছুই নাই, এই বিষখালী আমার সব খাইছে।’

নলছিটি ভবানীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যে গতিতে নদী ভাঙছে, তাতে ভবানীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও চাঁনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় অচিরেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সরকার যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয় তবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করা যাবে না।’

jagonews24

বিষখালী নদীর ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও লঞ্চঘাট, বড়ইয়া ইউনিয়নের কাঁচারিবাড়ি বাজার, চল্লিশকাহনিয়া ও মানকিসুন্দর গ্রাম, নলছিটি উপজেলার হদুয়া দরবার শরিফ, দেউরি সাইক্লোন শেল্টার, ভবানীপুর লঞ্চঘাট ও বাজার, বৈশাখীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসা, চাঁনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু স্থাপনা।

রাজাপুর বাঁদুরতলা এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বাড়িঘর আগেই নদীতে গেছে। গত এক সপ্তাহে বাঁদুরতলা লঞ্চঘাট এলাকায় বেশকিছু দোকান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের মুখে রয়েছে।’

রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘বিষখালী নদীর ভাঙনে দোকান, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। আমরা তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করছি। তবে দ্রুত নদীভাঙন ঠেকাতে না পারলে আরও অনেক পরিবার সর্বস্ব হারাবে।’

কাঠালিয়ায় বিষখালী নদীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে কাঠালিয়া উপজেলা পরিষদ, অফিসপাড়া, লঞ্চঘাট, আউরা হাট, কচুয়া খেয়াঘাট, আমুয়া বন্দর, চিংড়াখালী বাজার ও আওরাবুনিয়া বাজারের বহু স্থাপনা ভাঙন হুমকিতে রয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে শত শত একর কৃষিজমি।

jagonews24

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় কাঠালিয়া উপজেলা পরিষদের কোলঘেঁষা লঞ্চঘাট থেকে বড় কাঠালিয়া পর্যন্ত নদী তীরের তীব্র ভাঙনে হুমকিতে রয়েছে উপজেলা পরিষদ ও অফিসপাড়া। এছাড়া কাঠালিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঠালিয়া পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, নদী তীরবর্তী বসতবাড়ি ও বহু স্থাপনাও হুমকিতে রয়েছে। বিলীন হচ্ছে শত শত একর কৃষিজমি। উপজেলার চিংড়াখালী গ্রামের জেলে ফারুক বলেন, ‘প্রতি বছর গলাসমান পানিতে আমাদের ঘর, গরু-বাছুর সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুফল চন্দ্র গোলদার জানান, বিষখালী নদীতে বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ার আসলেই ভাঙন অংশ দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ছোট ছোট ভাঙন মেরামত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই বেড়িবাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চলছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান মো. এমাদুল হক মনির বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর দেড় বছর আগে বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর কাছে সরাসরি গিয়ে চিঠি দিয়ে এসেছি। তিনি চিঠিটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর পাঠিয়েছেন। শিগগিরই বেড়িবাঁধের সমাধান হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান শুভ জানান, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ভাঙন থেকে রক্ষাকল্পে স্থায়ী বেড়িবাধ নির্মাণ শেষে ব্লক স্থাপন ও খনন কাজের জন্য ৬৯৫ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটির সভায় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

মো. আতিকুর রহমান/এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।