এত ঝুঁকির কাজেও কোনো ভাতা নেই সাফারি পার্কের বনকর্মীদের
কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক বিগত প্রায় দু’যুগ ধরে প্রকৃতিপ্রেমী, শিক্ষার্থী এবং সববয়সী মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসছে। দর্শনার্থীদের বিনোদনে পার্কে ১৯টি বেষ্টনীর মধ্যে সংরক্ষিত আছে বিচিত্রসব প্রাণী। পার্কের ভেতরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় উন্মুক্ত ও আবদ্ধভাবে রয়েছে হাতি, বাঘ, সিংহ, জলহস্তী, গয়াল, আফ্রিকান জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভাল্লুক, বন্য শুকর, হনুমান, ময়ূর, স্বাদু ও লোনা পানির কুমির, সাপ, বনগরুসহ দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির প্রাণী। পার্কজুড়ে রয়েছে চিত্রা, মায়া, সম্বর ও প্যারা হরিণ।
রয়েছে নাম জানা অজানা বিচিত্র কয়েকশ ধরনের পাখি। এর পাশাপাশি পার্কে দেখা মেলে কালের সাক্ষি বিশালাকার দুর্লভ ও মূল্যবান বৃক্ষরাজি। সেসব গাছেই বানরের লাফালাফি নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের।
বিনোদন অনুষঙ্গ এসব প্রাণীগুলোকে পরিচর্যায় পার্কে কাজ করছেন নানা পদে ৫২ জন বনকর্মী। এদের মাঝে অনেককে সামলাতে হয় হিংস্র সব প্রাণীকে। বাঘ, সিংহ, জলহস্তী, গয়াল, আফ্রিকান জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভাল্লুক, বন্য শুকরসহ অন্য হিংস্র পাণীগুলো অনেক সময় পরিচর্যাকারীকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে মারাত্মক আহত হন।
তারপরও ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন কাজ করলেও এখানে কর্মরতদের নেই কোনো ঝুঁকিভাতা। ফলে অনেকে এখান থেকে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে উন্মুখ হয়ে থাকেন।
পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে সামান্য কতগুলো আবদ্ধ প্রাণীইতো সামলাচ্ছে! কিন্তু বাস্তবিকতায় এটা দুঃসাহসিক কাজ। বনের পশুগুলোকে মানব মর্জিতে চলতে অভ্যস্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। আবদ্ধ সকল প্রাণীকে নিয়ম মাফিক খাবার দিতে হয়। বাঘ ও সিংহের খাঁচায় মাংস দেওয়া, কুমিরকে জীবন্ত মুরগি সরবরাহ, ভল্লুক, লামচিতা, শুকরসহ কামড়ায় এমন সব প্রাণীকে একেকজন দেখভাল করেন।
বিশালাকার হাতি, জলহস্তীসহ অন্য প্রাণীদের সামাল দেওয়া ঝুঁকির। নিয়ন্ত্রণ মানলে ভালো, কিন্তু হঠাৎ যদি ক্ষেপে গিয়ে আক্রমণ করে তখন আহত হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। আক্রান্ত হচ্ছে এটা দেখলে অন্যজন এসে রক্ষা করতে পারলে অল্প আঘাতে বাঁচে। না দেখলে আরো অনেক বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বন কর্মকর্তা মাজহার বলেন, একদিন সন্ধ্যার আগে মাংস দিতে গেলে হঠাৎ খাঁচার বাইরে চলে আসে একটি বাঘ। বেরিয়ে বনের দিকে হাঁটতে থাকায় সকল পরিচর্যাকারী ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপরও নিয়মিত পরিচর্যাকারী কর্মী বাঘটিকে নাম ধরে ডেকে দাঁড় করায়। নিজের দিকে আহ্বান করার পর ফিরে আসে বাঘটি। পাশে এলে গায়ের কেশে বিনি কেটে আদর করে ভুলিয়ে আবার খাঁচায় ঢুকানো হয়। এটি চরম ঝুঁকির মুহূর্ত ছিলো। বাঘটি আক্রমণ করে বসলে কিছু করার থাকতো না।
তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন আগেই একটি বন্য শুকরের আক্রমণে আঘাত পেয়েছেন বীরসেন নামে এক বনকর্মী। বেষ্টনী থেকে কৌশলে বেরিয়ে যেতে গিয়ে ফাঁদে আটকে যাওয়া শুকরকে মুক্ত করতে গেলেই উল্টো আক্রমণ করে বসে সেটি। মুক্ত প্রাণীগুলো এভাবে কাউকে না কাউকে আঘাত করেই। এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা হলেও এখানে কর্মরতরা ঝুঁকিভাতা পান না।
পার্ক তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলামের মতে, সামনে সাফারি সিস্টেম চালু হলে আরো ঝুঁকি বাড়বে। উন্মুক্ত হিংস্র প্রাণীগুলোকে পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আঘাত পেতেই পারেন কর্মীরা। তাই তাদের স্বাভাবিক বেতনের সঙ্গে ঝুঁকিভাতা চালু করা সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কক্সবাজারের মানবাধিকারকর্মী জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী মো. রেজাউর রহমান রেজা বলেন, রাষ্ট্রীয় যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতদের ঝুঁকিভাতা প্রাপ্তি তার নৈতিক অধিকারে পড়ে। সাফারি পার্কে প্রাণীকূল সামলানো অবশ্যই ঝুঁকির কাজ। সরকারের আদেশে যেহেতু এ দায়িত্বপালন, সেহেতু এখানে পোস্টিং নেওয়া সকলকে ঝুঁকিভাতার আওতায় আনা অতি জরুরি।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠার ২৪ বছরের মাথায় অত্যাধুনিক রূপ পাচ্ছে পার্কটি। মহাসড়ক থেকে পার্কে প্রবেশের মূল গেট পর্যন্ত এলাকায় আশপাশে দখলে থাকা বনভূমি উদ্ধারের পর তৈরি করা হচ্ছে বাস, মাইক্রোবাস এবং মোটরসাইকেলের আলাদা পার্কিং। একদিক দিয়ে প্রবেশ, অন্যদিক দিয়ে বাহিরের নির্দেশনায় পার্কিংয়ে থাকছে নতুনত্ব। পার্কের লাগোয়া পূর্বপাশেই গড়া হয়েছে সাদা উড়ন্ত পায়রা হাতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। ভাস্কর্য এলাকাটি সবুজের আবরণের পাশাপাশি করা হচ্ছে ফুল বাগানও। পার্কের দক্ষিণে পিকনিক স্পটের মাঝে করা হচ্ছে পর্যটকদের জন্য রেস্টিং শেড। এরই কূল ঘেঁষে পাহাড়ের পাদদেশে সবুজের বুকে জলজ বিনোদনে গড়ে তোলা হচ্ছে কৃত্রিম লেকও। আগামী বছর থেকে হিংস্র প্রাণীগুলোকে সাফারি অংশে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।
এফএ/জেআইএম