সংগ্রামী নারী বাইকার রতনা

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ০২:৩৫ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২২
হার না মানা রতনার জীবিকার উৎস মোটরসাইকেল

রতনা বেগম। বয়স চল্লিশের কোঠায়। অন্য দশজন মেয়ের মতো জীবন নয় রতনার। নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করেই চলছে তার জীবন। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে নিজের মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে আসেন। এরপর সেখান থেকে গরুর মাথা ও ভুঁড়ি কিনে নেন। আবার ফিরে যান তার নিজ শহর যশোরে। সেখানে নিয়ে তা বিক্রি করেন। এই ব্যবসায় যে লাভ হয় সেই টাকা দিয়েই চলে মা আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রতনার সংসার।

রতনা যশোর পুলিশ লাইনের পাশে টালিখোলা এলাকার মৃত সিদ্দিক সরদারের মেয়ে। মা নুরজাহান বেগম। ছয় বোনের সবার বড় রতনা। যশোর শহরের টালিখোলায় একটি ভাড়া বাড়িতে এক সন্তান আর মাকে নিয়ে বসবাস তার। স্বামী অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। জমাজমি বলতে কিছু নেই। বাড়ির পাশের গড়ে তুলেছেন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি গরুর মাথা ও ভুঁড়ি বিক্রি করেন। এছাড়া যদি কেউ গরুর মাংসের অর্ডার করেন তাহলে সেদিন গরু কিনে জবাই দেন।

সম্প্রতি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর শহরের নতুন বাজারের মাংসের বাজারে কথা হয় রতনার সঙ্গে। স্বামীর নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় যশোর সদর উপজেলার অ্যাড়েন্দা গ্রামে। এক বছরের মাথায় কোলজুড়ে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। ছেলের বয়স যখন আটবছর তখন স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর যশোর শহরের টালিখোলায় চলে আসি। প্রথমে কালীগঞ্জ থেকে গরুর মাথা ও ভুঁড়ি কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতাম। পড়ে স্থায়ী একটি দোকান করে নিই।

এভাবেই ১৪ বছর ধরে চলছে রতনার ব্যবসা। বর্তমানে ছেলের বয়স ১৯ বছর। ছেলে এখন যশোরের একটি পলিটেকনিক কলেজে ডিপ্লোমা করছেন।

সাত বছর হলো মোটরসাইকেল চালিয়ে যশোর থেকে কালীগঞ্জে গিয়ে প্রতিদিন ভুঁড়ি ও গরুর মাথা কিনি। এক বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সও করে নিয়েছি। তবে, চলার পথে পুলিশ আমাকে কিছু বলে না, সবাই আমাকে চেনে। তারপরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করে নিয়েছি, বলছিলেন রতনা।

কালীগঞ্জ নতুন বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমার কাছ থেকে ভুঁড়ি ও গরুর মাথা কিনে নিয়ে যায় রতনা। আগে বাসে আসতো, এখন মোটরসাইকেল চালিয়ে আসে। এরপর গরুর ভুঁড়ি ও মাথা কিনে বাসে তুলে দেয়। এরপর রতনা তার মোটরবাইকে চড়ে যশোর ফিরে যায়।

তিনি বলেন, রতনা আপা খুব ভালো মানুষ। আমরা তার কাজে যথাসম্ভব সহযোগিতা করি।

কালীগঞ্জ শহরের নতুন বাজারের মাংস বাজারের পাশের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী হাসিব ট্রেডার্সের মালিক তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে দেখি রতনা নামে ওই নারী মোটরসাইকেল চালিয়ে আসেন। এরপর গরুর মাথা ও ভুঁড়ি কিনে নিয়ে যান। পরে জেনেছি যশোর থেকে ৪০ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে কালীগঞ্জে আসেন। তার মতো এরকম সংগ্রামী নারী আগে কখনো দেখিনি।

নিজের জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে রতনা আরও বললেন, কালীগঞ্জে যাওয়া-আসার সুবাদে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। একটা সময় ওই যুবক তার কোনো স্ত্রী-সন্তান নেই জানিয়ে আমাকে বিয়ে করেন। পরে জানতে পারি, তার স্ত্রী-সন্তান সবই আছে। এরপর তার আগের স্ত্রী ব্র্যাকের শালিস কেন্দ্রে অভিযোগ করেন। সেখানে বিচার হয়। বিচারে আমার স্বামীকে প্রথম স্ত্রীর ভরণ-পোষণ বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা দেওয়ার রায় হয়। এ টাকা আমিই পরিশোধ করতাম। বর্তমানে আমার এই সামান্য ব্যবসা থেকে এত টাকার যোগান আর দিতে পারছি না। এখন তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি।

পরিশেষে জীবন যুদ্ধে অদম্য সংগ্রামী রতনা বললেন, আমি একজন নারী। যাওয়া-আসার পথে বিপদ-আপদে প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতা চাই।

এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।