সুদের টাকায় এনজিওর কিস্তি দিচ্ছেন বানভাসিরা

লিপসন আহমেদ লিপসন আহমেদ , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:১৭ এএম, ০১ আগস্ট ২০২২

সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় বসতঘর হারিয়েছেন লাখো মানুষ। শূন্য হয়েছে ধানের গোলা, একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে মাছের খামার, পোল্ট্রি খামার, ছোট-খাটো ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি-কৃষিজ পণ্যসহ উপার্জনের নানা খাত। নিঃস্ব এসব মানুষের অনেকের খাবারেরই সংস্থান নেই। কিন্তু বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে চড়া সুদে ঋণ করতে হচ্ছে তাদেরকে।

সুনামগঞ্জ শহরতলির কোরবাননগর ইউনিয়নের হাছনবাহারের হামিদা বেগমের স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। নিজের ঘর তৈরির জন্য বন্যার আগে তিনটি এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করেন হামিদা বেগম। ঘর তৈরির আগেই বন্যায় ভেসে গেছে পুরাতন ঘরসহ সবকিছু। এখন তিন সন্তানসহ পরিবারের খাবারেরই ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় তিন এনজিও’র কিস্তির টাকা ও সংসার চালানোর খরচের জন্য চড়া সুদে টাকা নিয়েছেন এক সুদের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে।

হাছনবাহার গ্রামের বাসিন্দা গৃহিণী হামিদা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম স্বামী-স্ত্রী এনজিও থেকে ঋণ তুলে সুন্দর করে ঘর বানাব। কিন্তু বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। স্বামীর কোনো কাজ কামও নাই। এখন এনজিওর মানুষ কিস্তি নেওয়ার জন্য বাসায় এসে বসে থাকে। কিস্তি না দিতে পারলে গালিগালাজ করে। সম্মান বাঁচাতে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে কিস্তি পরিশোধ করছি।

সুদের টাকায় এনজিওর কিস্তি দিচ্ছেন বানভাসিরা

এদিকে বাবা ঋণ নিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন গত শনিবার। সোমবার এনজিওর ঋণ কর্মকর্তা এসে বলেন ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরে মৃতের মেয়ে ঋণ কর্মকর্তার সামনে উপস্থিত হয়ে বাবার কিস্তির টাকা দফারফা করেন।

মৃত আব্দুল ওয়াহাবের মেয়ে মনিরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাবা যখন সুস্থ ছিলেন তখন এনজিও থেকে কিস্তি তুলেছিলেন। পরে আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিক তখন এনজিওর কর্মকর্তারা এসে কিস্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। পরে আমার মা বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে থাকেন। কিন্তু বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। গত শনিবার আমার অসুস্থ বাবাও মারা গেছেন। বিষয়টি অফিসকে জানানো হয়েছে। কিন্তু গত সোমবার কিস্তির টাকার জন্য এসে এনজিওর কর্মকর্তারা চাপ প্রয়োগ করে এবং লাশ ঘরে থাকলেও কিস্তি বন্ধ রাখা যাবে না বলে জানায়। পরে বাধ্য হয়ে সঞ্চয়ের যে জমা করা টাকা ছিল আমার সেটা থেকে কিস্তির টাকা পরিশোধ করেছি।

সুদের টাকায় এনজিওর কিস্তি দিচ্ছেন বানভাসিরা

সুনামগঞ্জ শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কোরবাননগর ইউনিয়নের হাছনবাহার গ্রামে গিয়ে এমন মর্মান্তিক কাহিনী শোনা গেছে। গ্রামের ২৫০ পরিবারের মধ্যে ২০০ পরিবারই এনজিও’র ঋণের জালে বন্দি। কিছু কিছু পরিবার তিন-চারটি এনজিও থেকে ঋণ তুলেছে। গত ১৬ জুনের ভয়াবহ বন্যায় এসব পরিবারের সবকিছু ভেসে যাওয়ার পর এরা এখন নিঃস্ব।

বেশিরভাগের খাবারেরই সংস্থান নেই। কিন্তু ঋণের কিস্তি মাপ নেই। কিস্তি পরিশোধের জন্য বানভাসি মানুষদের অনেকেরই যেতে হচ্ছে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে।

সরেজমিনে হাছনবাহার গ্রামের বন্দেবাড়ী এলাকায় গিয়ে বিষণ্ন মন নিয়ে কমপক্ষে ২০ জন নারীকে কিস্তির টাকা ও বই হাতে এনজিওর (আশা) ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুককে ঘিরে দাঁড়াতে দেখা গেলো। ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুক হাজেরা বেগম, রাবিয়া বেগম, বাহার বেগম, সাহানারা বেগম, রাহেলা বেগম ও মাসুদা বেগমসহ অনেকের কিস্তির টাকা নিয়ে বইয়ে হিসাব লিখে দিয়েছেন।

সুদের টাকায় এনজিওর কিস্তি দিচ্ছেন বানভাসিরা

অবশ্য ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুকের মন্তব্য, ‘আমরা কিস্তি আদায় করছি না। ঋণ গ্রহিতাদের এক হাজার টাকা ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বিতরণের জন্য এসেছি।’

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায় স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ঋণ আদায় আপাতত স্থগিত রাখার জন্য সার্কুলার প্রদান করা হয়েছে। এরপরও এই বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পত্র পাঠানো হবে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।