শেরপুরে সুদকারবারিদের ফাঁদে নিঃস্ব হচ্ছে অসহায় মানুষ

ইমরান হাসান রাব্বী ইমরান হাসান রাব্বী , শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৪:০৪ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২২

জীবিকার তাগিদে রাজধানী ঢাকায় রিকশা চালাতেন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সাদেকুল ইসলাম। স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে নিয়ে থাকতেন ঢাকাতেই। বছর দেড়েক আগে পারিবারিক প্রয়োজনে ঝিনাইগাতী উপজেলার গৌরীপুর গ্রামের সুদকারবারি মালেক মিয়ার কাছ থেকে সুদে ১৮ হাজার টাকা ঋণ নেন। পরে রিকশা চালিয়ে ২৩ হাজার টাকা পরিশোধও করেন।

তবে দাবি অনুযায়ী, সুদে-আসলে আরও ৪০ হাজার টাকা দিতে না পারায় সাদেকুলের বাবা ও ভাইয়ের তিনটি গরু জোর করে নিয়ে যান মালেক মিয়া। এরপর কিছুদিন আগে সাদেকুলের বসতঘর ভেঙে টিন, খুঁটি ও আসবাবপত্র পর্যন্ত নিয়ে যান তিনি।

শুধু সাদেকুল ও মনোয়ারা দম্পতিই নয়, মালেকের মতো স্থানীয় প্রভাবশালী সুদকারবারির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। সময়মতো সুদের টাকা দিতে না পারায় জোর করে গবাদিপশু, জমি ও বসতভিটা দখলসহ মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে।

তাদের দৌরাত্মে এলাকাছাড়া হয়েছেন অনেকেই। তবে কোনো লিখিত প্রমাণ না থাকায় এসব দাদন (সুদ) ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন না ভুক্তভোগীরা। এতে বেঁচে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেরপুরে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধিত সমিতি রয়েছে এক হাজার ১০৫টি। তবে বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক সমিতি ও ব্যক্তি নিবন্ধন ছাড়াই জেলাজুড়ে সুদের কারবার চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে টাকা ধার পাওয়া যতটা কষ্টের, ঠিক ততটাই সহজ এসব সমিতি বা ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া।

কোনো তফসিলি ব্যাংকের চেক অথবা স্বর্ণালংকার জমা দিয়ে নিতে হয় টাকা। ঋণগ্রহীতারা ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য হলেও দিনমজুর, ভ্যান বা রিকশাচালক থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ীরা।

সদর উপজেলার চরশেরপুর তালুকপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী বাবুল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সুদের ওপর সোয়া এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। পরে তিন কিস্তিতে ৬৫ হাজার টাকা সুদও দিয়েছি। তবে দাদন ব্যবসায়ী রফিকুল আসল ছাড়াই আরও এক লাখ টাকা লাভ দাবি করছেন। এজন্য কিছুদিন ধরে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শেরপুর শহরে ভাড়া থাকছি।’

শহরের আখেরমামুদ বাজারের ব্যবসায়ী মিসকিন মিয়া জানান, তিনি স্থানীয় এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুদের ওপর তিন লাখ টাকা ঋণ নেন। এরপর প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই দাদন ব্যবসায়ী আরও সুদ দাবি করলে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় আসল তিন লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে।

এ বিষয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে ব্যাংকের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করা বা সদস্যদের বাইরে ঋণ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। এরকম কোনো অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিকার করে থাকি।

নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ শেরপুরের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সমাজের অসহায় মানুষের সচেতনতার অভাবের সুযোগ নিচ্ছেন এসব দাদন ব্যবসায়ী। তাদের কারণে সামাজিক অপরাধও বাড়ছে। এটি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মালেক মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি সুদের ব্যবসা করি না। কেউ বলতে পারবে না, আমি সুদের ব্যবসা করি। আমি সাদেকুলের কাছ থেকে ন্যায্য টাকায় ঘর কিনে নিছি। তার বাবা ও ভাইয়েরা আমাকে ঘর বুঝায়া দিছে।’

তবে জাগো নিউজকে এ বক্তব্য দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রেফতার হন মালেক মিয়া। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল আলম ভুইয়া বলেন, ভুক্তভোগীদের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মালেক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তবে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও অভিযুক্ত রফিকুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সরকার অনুমোদিত নয়, অথবা সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই এমন সুদের ব্যবসা সমাজে থাকলে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেরপুরের পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ভুক্তভোগীদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা আমাদের স্থানীয় বা জাতীয় হটলাইনে কল দিয়ে বিষয়টি জানান। আমরা আপনাদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।