মাদারীপুরের হরিজন সম্প্রদায়

এক ঘরে তিন প্রজন্মের ঠাসাঠাসি করে বসবাস

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী আয়শা সিদ্দিকা আকাশী , জেলা প্রতিনিধি মাদারীপুর
প্রকাশিত: ০৭:৫৮ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

মাদারীপুর শহরের পুরানবাজারে অবস্থিত হরিজন পল্লি। দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস। তবে ঘরের সংখ্যা মাত্র ৪০-৪৫টি। একেকটি ঘরে ৭-৮ জন, আবার কোনো ঘরে ১০ জন করেও জড়োসড়োভাবে বসবাস করে।

দীর্ঘদিন ধরে আরও ঘরের দাবি জানিয়ে আসছেন এখানকার বাসিন্দারা। তবে এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, শিগগির তাদের জন্য সাত তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর শহরের পুরানবাজার সড়কের পাশেই হরিজন পল্লি। এখানে দেড় শতাধিক পরিবারের সাড়ে চারশোর মতো সদস্য আছেন। ভূমিহীন এ জনগোষ্ঠীর মানুষ বরাবরই আর্থিক অনটন, চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বেকারত্বে ভুগছেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে উঠছেন এ সম্প্রদায়ের শিশুরা।

সরেজমিন দেখা যায়, মাদারীপুর হরিজন পল্লিতে ঢুকতেই একটি মন্দির ঘর। মন্দিরের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি ঘর মেশানো। তার পাশে রয়েছে ময়লার ড্রেন। পাশেই খেলা করছে শিশুরা।

আরও পড়ুন: শীতের পিঠা বিক্রি করে দৈনিক আয় ২০০০-৩৫০০ টাকা

কৈলাশ জমাদ্দার নামের একজন বলেন, ‘এখানে মানুষের সংখ্যা বেশি কিন্তু ঘর খুব কম। বসবাস করতে খুব অসুবিধা হয়। দুই ছেলে, বউ, নাতি নিয়ে একঘরেই থাকতে হয়। বর্ষার দিনে পানি জমে। শুনেছি এখানে আমাদের জন্য সাততলা বিল্ডিং হবে। বেশ কয়েকবার সরকারের লোক এসে জমির মাপও নিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল চোখে দেখিনি।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে আরেক বাসিন্দা সেলিম জমাদ্দার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শহর পরিষ্কার করি। কিন্তু আমাদের ব্যাপারে এত অবহেলা কেন, জানি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, আমাদের জন্য নতুন ভবনটি দ্রুত করে দেওয়া হোক।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগের মতো এই হরিজন পল্লির মানুষগুলো শুধু ঘরে বসে থাকেন না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। অনেকেই কলেজে পড়ছেন। প্রতিভা বিশ্বাস নামের একজন গৃহবধূ বর্তমানে মাদারীপুরের সরকারি সুফিয়া মহিলা কলেজে বিএ পড়ছেন।

আরও পড়ুন: ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে ভাগ্য বদল কৃষকের

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে সরকারিভাবে ভারতবর্ষের হারিয়ানা প্রদেশ থেকে আনা হয় হরিজন সম্পদায়ের মানুষদের। পুরানবাজার এলাকার ১ একর ৩৮ শতাংশ জমিতে গড়ে উঠেছে হরিজন পল্লি। বর্তমানে পল্লিতে চাহিদা অনুযায়ী ঘর নেই। ফলে এখানে তিন প্রজন্ম একই ঘরে ঠাসাঠাসিভাবে বসবাস করছেন।

তিনি বলেন, ‘দিন দিন হরিজন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা অনুসারে তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। আবাসন, পানি ও পর্যাপ্ত শৌচাগার সংকট, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় আছেন তারা।’

হরিজন সম্প্রদায়ের আটটি গোত্র রয়েছে জানিয়ে এ ইতিহাসবিদ বলেন, ‘মাদারীপুরে ডোম ও হরি নামের দুটি গোত্রের লোকেরা বাস করেন। এখানে এরা অনেক অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখলেও সহজে চাকরি পান না। মাদারীপুর পৌরসভা তাদের জন্য আবাসন ব্যবস্থার কথা বললেও এখনো তার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাদারীপুর শহরের পুরানবাজারটি হচ্ছে জেলার সবচেয়ে বড় ও প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে জমির দামও বেশি। তাই প্রভাবশালীরা কৌশলে হরিজন পল্লির বেশকিছু জমি দখল নিয়েছেন। পল্লির চারপাশে উঁচু ভবন নির্মিত হওয়ায় প্রায় সময় পানিতে ডুবে যায়। নিষ্কাশনের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তাদের বসবাস।’

আরও পড়ুন: কোনো কাজ নাই, মেট্রোরেলে চড়তে এসেছি

মাদারীপুর সদর উপজেলা এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য সবধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করা হবে। ভবনটি হবে সাত তলাবিশিষ্ট। এরই মধ্যে জমির মাপ ও মাটি পরীক্ষাসহ সব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আনুমানিক প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ভবন নির্মাণ হবে। জানুয়ারিতেই কাজের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

জানতে চাইলে মাদারীপুর সদর উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ৫৭টি পরিবারকে তালিকাভুক্ত করেছি। আমাদের সব কাজ শেষ হয়েছে। এখন টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এ বছরের শুরুতেই কাজ শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি।’

মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ জাগো নিউজকে বলেন, মাদারীপুরের হরিজনদের জন্য সাত তলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করা হবে। তবে কাজটি করবে এলজিইডি। পৌরসভা তত্ত্বাবধানে থাকবে। তাদের সঙ্গে আমাদের সভা হয়েছে। আশা করছি এ মাসে বা আগামী মাসের মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।