‘পর্যটন কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে শিমুলিয়া ঘাট

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মুন্সিগঞ্জ
প্রকাশিত: ১০:৩৬ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফেরির হুইসেল আর মানুষের পদচারণায় একসময় দিনরাত মুখিরত ছিলো মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মাপাড়ের শিমুলিয়া ঘাট। প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিয়ে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত ছিলো এ নদী বন্দর। ছিল নৌ পারাপার ঘিরে অজস্র ভোগান্তি, দুর্ভোগ, আনন্দ-বেদনা, গন্তব্যে ফেরার প্রতিযোগিতার গল্প। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পাল্টে গেছে চিরচেনা সেই চিত্র। একসময়ের লোকারণ্য এ ঘাট এখন আরও কেউ পারাপারের অপেক্ষায় থাক না। যাত্রীশূন্য হলেও শিমুলিয়াঘাটে তৈরি হয়েছে নতুন রূপ। পদ্মা সেতু, পদ্মার নির্মল বাতাস, ইলিশ ভাজাসহ নানা কারণে দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফেরি ঘাটটি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা কাছে হওয়ায় যান্ত্রিক কোলাহলে বদ্ধ মানুষের নিয়মিত আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠেছে এ ঘাটটি। যেন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নতুন রূপ নিয়েছে শিমুলিয়া ঘাট।

jagonews24

সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত সরজমিনে দেখা যায়, নৌ চলাচল না থাকলেও হাজারো মানুষের ভিড় ঘাট এলাকায়। ৩ নম্বর রোরো ফেরিঘাটের পার্কিং ওয়ার্ডে মানুষের অনেকটাই মিলনমেলা। নানা রকমের জিনিসপত্র কেনাবেচা আর খাবারের দোকান বসেছে। রয়েছে বাহারি খাবার, শামুক ঝিনুকের অলংকার, পোষাকের দোকান, শিশুদের রাইডসহ নানা দোকান। হরেক রকেমের চা-পানের দোকান, বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি। দর্শনার্থীদের কেউ বন্ধুদের সঙ্গে দল ধরে আবার কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে। ঘাট থেকে কিছুটা দূরে পদ্মা সেতুর ধূসর কাঠামো উপর সন্ধ্যার পর সড়ক বাতিগুলো মুক্তার মালা রূপে আবিভূত হয়।

আরও পড়ুন: সৈকতের শহরে রাতের বিনোদন কক্সবাজার শিল্প ও বাণিজ্যমেলা

স্থানীয় কয়েকজন দোকানদার জনান, প্রতিদিন বিকালের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ঘাটে আসছে। রাত যত গভীর হয় মানুষের উপস্থিতি যেন তত বাড়ে। বিশেষ করে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারসহ বিভিন্ন ছুটির দিন বিকেল থেকে দর্শনার্থীদের চাপ বাড়ে। চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।

jagonews24

ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আসা ফিরোজ আলম জানান, শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় বন্ধুরা সবাই মিলে এসেছি। বিকেলে পদ্মা সেতু এবং নদীর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলাম। একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে মাঝে মধ্যেই আসি। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত সময় কাটাই।

আরও পড়ুন: ব্যস্ততা আর ক্লান্তি ভোলার মাধ্যম ‘পুষ্প কানন’

আরেক দর্শনার্থী সুফিয়ান জাগো নিউজকে জানান, রাতের শিমুলিয়া ঘাট ভালো লাগে। পদ্মা সেতুর মিটমিট বাতি সুন্দর লাগে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে দ্রুতই আসা যায়। এলাম, ইলিশ ভাজা খেলাম, ভালোই লাগছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিরা ইয়াসমিন বলেন, মূলত নদীর কাছে আসলে মন ফ্রেস হয়, পানির ঢেউ আর হিমেল বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়।

jagonews24

এদিকে, জমজমাট বেচাকেনায় খুশি বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা। আমিনুল ইসলাম নামের এক ভ্রাম্যমাণ ফুচকা বিক্রেতা জানান, মানুষের অনেক উপস্থিতি। বেচাকেনাও ভালো। বিকালে আসি রাত ১-২টা পর্যন্ত থাকি।

আরেক দোকানদার আশিক বলেন, চা, চিপস, পানি, কেক, রুটি বেচাকেনা করি। কয়েক হাজার টাকার বেচাকেনা হয় নিয়মিত।

ইলিশ ভাজার কারণে কদর কমেনি রেস্তোরাঁর

পদ্মার ইলিশ ভাজা খেতে ভোজনরসিকদের প্রথম পছন্দ শিমুলিয়া ঘাটের রেস্তোরাঁ। আগে এ ঘাট হয়ে গন্তব্যে যাতায়াত করা মানুষ আর ভোজনরসিকদের ভিড় ছিলো এখানকার সব রেস্তোরাঁয়। এখন যাত্রীর যাতায়াত না থাকায় ক্রেতা কিছুটা কমছে। তবে কদর কমেনি ভোজনরসিকদের। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনও প্রতিদিন দেখা মেলে শত শত দর্শনার্থী-ক্রেতার। বিশেষ করে রাতে দর্শনার্থীরা ভিড় বেশি থাকে।

jagonews24

আরও পড়ুন: পরিযায়ী পাখিতে মুখর নীলসাগর

হোটেল রেস্তোরাঁ সংশ্লিষ্টরা জানায়, এখনও প্রচুর মানুষ আসে। পদ্মা সেতুর পর ব্যবসা বাণিজ্যে ভাটা পড়ার যে দুশ্চিন্তা ছিলো তেমনটি হয়নি। ভ্রাম্যমাণ কিছু দোকান বন্ধ হয়েছে। তবে খাবার রেস্তোরাঁ চলছে। বরং রেস্তোরাঁর সংখ্যা বৃদ্ধিও পেয়েছে।

মাওয়া ঘাটের স্বপ্নের তাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের বিদ্যুৎ খান বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর মনে করছিলাম বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু তা হয়নি। প্রতিদিন ভালোই মানুষ হয়।

বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলার বিড়ম্বনা

রাতের বেলা লোক সমাগমে মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এসবের মধ্যে মদ্যপদের উপদ্রব আর নারী ঘটিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগও পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

কয়েকজন দোকানদাররা বলেন, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে লোকসমাগম আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে ঘাট কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান আরও বাড়বে।

আরও পড়ুন: পর্যটক টানছে নাইক্ষ্যংছড়ির উপবন পর্যটন লেক

পদ্মা সেতু উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসাইন বলেন, রাতে দর্শনার্থীর পাশাপাশি বিশৃঙ্খলাকারীরাও আসে। তবে আমরা তৎপর থাকি।

jagonews24

ইকো-পোর্ট গড়ার পরিকল্পনা

লৌহজং উপজেলা প্রশাসন সূত্রে শিমুলিয়া ঘাটে ইকো-পোর্ট নির্মাণের সরকারি পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, পদ্মার রূপালী ইলিশের কারণে এটি আকর্ষণীয় স্থান। ঢাকার নিকটবর্তী এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখানে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। সরকার ইতিমধ্যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং শিমুলিয়া ঘাট ঘিরে ইকো-পোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি নির্মাণ হলে পর্যটনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আশা করছি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই স্থানটি তখন আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

পর্যটক নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ঘাটকেন্দ্রিক কার্যক্রম কমে গেছে। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের মতো নেই। তবে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেখানে আমরা টহলের ব্যবস্থা করেছি এবং ইজারাদারদের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আরাফাত রায়হান সাকিব/এএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।