আসামির আত্মীয়কে থানায় নিয়ে নির্যাতন
৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ দুই পুলিশ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে
শরীয়তপুরের জাজিরা পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় আসামির এক আত্মীয়কে পিটিয়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিচার চেয়ে গত ২ জুন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শরীয়তপুর পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন আবু জাফর নামের ওই ভুক্তভোগী। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন পুলিশ সুপার।
অভিযোগে সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ মে গভীর রাতে ভুক্তভোগী আবু জাফরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে থানায় নিয়ে যায় পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানাপুলিশ। সেখানে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে মামলার চারজন আসামির আত্মীয়ের পক্ষে ৭২ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। বলা হয়, বিনিময়ে তাকে ওই আসামি আত্মীয়দের মালিকানাধীন নাওডোবা বাজারের দুটি দোকানঘর তার নামে লিখে দেওয়া হবে।
প্রস্তাবে রাজি হননি আবু জাফর। তখন দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে মারধর করেন। ওসির কক্ষে আটকে চোখ বেঁধে তাকে দুই ঘণ্টাব্যাপী পেটানো হয়। একপর্যায়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে দিতে রাজি হলে তার চাচা ও মামলার আসামি রশিদ চোকদারের জিম্মায় ভোররাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১ জুন সকালে ন্যাশনাল ব্যাংক নাওডোবা শাখায় নিজের হিসাব নম্বরের পাঁচটি চেকে ৭২ লাখ টাকা লিখে দেন আবু জাফর। স্বাক্ষরিত চেকগুলো ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে দেওয়া হয়। বাদীপক্ষের শহীদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির নামে চেক লিখে রাখা হয়।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মে জাজিরা উপজেলার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ নামের এক ব্যক্তি ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে ১৭ হাজার ডলার, নগদ বৈদেশিক মুদ্রা ও তিনটি মোবাইল ছিনতাই করা হয়েছিল। এতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা ছিনতাই হওয়ার অভিযোগ এনে ২৩ মে ৯ ব্যক্তিকে আসামি করে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এজাহারে নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী আবু জাফরের চার আত্মীয়কে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন জাফরের জাফরের চাচা বাদশা চোকদার ও তার ছেলে সাদ্দাম চোকদার এবং আরেক চাচা রশিদ চোকদার ও তার ছেলে বকুল চোকদার।
ভুক্তভোগী আবু জাফর বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি ছিনতাইয়ের টাকা উদ্ধারের জন্য বাদীরা জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারীসহ অন্যরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ছিনতাই হয়েছে ২১ লাখ টাকা কিন্তু আমার চাচাতো ভাইদের চাপ দিচ্ছে ৭২ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য। ২১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মামলায় ৭২ লাখ টাকা দাবি করায় আমি বিষয়টির প্রতিবাদ করেছিলাম। পরে সেদিনই বাদীপক্ষের সঙ্গে মিলে রাতেই পুলিশ বাড়ি থেকে আমাকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ওসির রুমে আটকে আমাকে চোখ বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে দুই ঘণ্টা ধরে শারীরিক নির্যাতন করেছেন। আমি চিৎকার করে হাতে-পায়ে ধরলেও আমাকে ছাড় দেননি।’
তিনি আরও বলেন, জাজিরার নাওডোবা বাজারে আমার চাচা ও চাচাতো ভাইদের দুটি দোকান ঘর আমাকে কিনে নেওয়ার জন্য চাপ দেয় পুলিশ। পরে আমাকে চালান করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখিয়ে নেন ওসি শেখ মোস্তাফিজুর। কিন্তু শহীদুল ইসলামের নামের ওই ব্যক্তির নামে চেকগুলো নেওয়া হয়েছে। পরে আমার কাছ থেকে দুটি নন–জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পেও সই নেন তারা। পরে ২ জুন পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। আমি এ নির্যাতনের বিচার চাই।
এ বিষয় পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) শেখ মোস্তাফিজুর রহমানের মোবাইল নম্বরে কল করলে সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ (পরিদর্শক, তদন্ত) রিসিভ করে বলেন, ‘ওসি স্যারকে প্রথমিকভাবে সদর পুলিশ লাইনসে রাখা হয়েছে। তবে ওই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে।’
জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী বলেন, ‘আমরা আবু জাফরকে কোনো সময়ই চাপ প্রয়োগ করিনি। যার ডলার এবং টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি আমার ভাগনে হন। সামাজিকভাবে চেয়েছিলাম বিষয়টি সমাধান করে দিতে। আবু জাফর স্বেচ্ছায় আসামিদের দোকান লিখে নিয়ে ৭২ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন।
মামলার আসামির আত্মীয়কে নির্যাতন করে চেক লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ ধরনের অভিযোগের কথা এখনো শুনতে পাইনি। সে যদি এসপি স্যারের বরাবর অভিযোগ দিয়ে থাকে তাহলে আপনারা এসপি স্যারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি কিছুই জানি না।’
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক বলেন, ‘ঘটনাটি আমি শুনেছি এবং একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান অভিযোগটির বিষয়ে তদন্ত করছেন। ভুক্তভোগী আবু জাফর ওরফে ঠান্ডু চোকদার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী।
এসআর/এএসএম