পাবনা মানসিক হাসপাতাল
উৎসাহী দর্শনার্থী-ইউটিউবারদের উৎপাতে নাকাল রোগী
অতিউৎসাহী একশ্রেণির দর্শনার্থী এবং ইউটিউবারদের উৎপাতে নাকাল পাবনা মানসিক হাসপাতালের রোগীরা। তাদের কারণে অনেক রোগীর মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বজনরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এসব উৎসাহী দর্শনার্থী এবং ইউটিউবারদের নিবৃত্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৫৯ সালে দুইশ, ১৯৬৬ সালে চারশ এবং ২০০০ সালে হাসপাতালটি পাঁচশ শয্যায় উন্নীত করা হয়। প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দী পর দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বা চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়েনি। চিকিৎসকের সংখ্যা যেখানে বাড়ানো দরকার সেখানে অনুমোদিত ৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ২০ জনের পদই শূন্য। এর মধ্যে পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ককে প্রশাসনিক কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও প্রতি বছর আউটডোরে ২৫-৩০ হাজার রোগী এবং আন্তঃবিভাগে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বেশ কয়েকজন পুরোনো কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসক, নার্স, ওষুধসহ শয্যা সংকট রয়েছে মানসিক হাসপাতালে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলছে এখানে চিকিৎসা কার্যক্রম। এর ওপর এখন বাড়তি বিড়ম্বনা হিসেবে যোগ হয়েছে ইউটিউবারদের উপদ্রব। তারা রোগীদের সঙ্গে নানারকম অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে সেগুলো ইউটিউবে ছাড়ছেন। এসব ভিডিও ধারণের উদ্দেশ্যই থাকে ভিউ বাড়ানো। এজন্য তারা অতিরঞ্জিত করে সবকিছু উপস্থাপন করেন।
মঙ্গলবার (৪ জুলাই) পাবনা মানসিক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল গেটে অনেক জটলা। কর্মরত আনসারদের সঙ্গে উৎসুক জনতার কথোপকথন চলছে। দর্শনার্থীরা সবাই ভেতরে যেতে চান তাদের ভাষায় ‘পাগল’ (মানসিক রোগী) দেখতে।
যারা ভেতরে ঢুকতে পারেননি তাদের দেখা গেছে, হাসপাতালের পেছন দিকের জানালার পাশে। তারা সেখানে রোগীদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে তাদের উত্ত্যক্ত করছিলেন।

হাসপাতালে আগত মামুন, মারুফ, মালেকসহ বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, তারা মূলত কৌতূহল নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তারা ভেতরে যেতে চান। রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তাদের ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজন নেই। তারা নিছক কৌতূহলের কারণেই এসেছেন। এসময় বেশকিছু তরুণকে মোবাইলফোনে ভিডিও করতে দেখা যায়। তারা উচ্চস্বরে রোগীদের সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা বলছিলেন।
এক দর্শনার্থী জানান, পাবনায় তেমন বিনোদনকেন্দ্র নেই। ঈদ উপলক্ষে বন্ধুরা মিলে এখানে এসেছেন। আনসারদের ১০০ টাকা দিয়ে তারা ভেতরে ঢুকেছেন। তবে আনসার সদস্যরা উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

হাসপাতালের এক প্রবীণ সেবিকা বলেন, আগেও লোকজন আসতেন। রোগীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন। না পারলে উকি-ঝুঁকি মেরে চলে যেতেন। এখন হাতে মোবাইলফোন আর বুম। ইউটিউবাররা এসে ভিডিও করেন। তারা ভিউ বাড়ানোর জন্য উল্টাপাল্টা তথ্য প্রচার করেন। তারা রোগীদের সঙ্গেও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন। এতে রোগীদের বিশ্রাম ব্যাহত হয়। তাদের মনঃসংযোগ নষ্ট হয়। এছাড়া রোগীদের ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ায় তারা সামাজিকভাবে হেয় হন।
ওই সেবিকা জানান, সুস্থ হওয়ার পর এক রোগী তার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন, ‘আপা আমরা নাকি পাগল? আমাদের ভিডিও প্রচার হচ্ছে’। ওই রোগীর অসুস্থ অবস্থায় সেই ভিডিও করা হলেও তিনি সুস্থ হওয়ার পর কিন্তু আপত্তি জানিয়েছেন। এজন্য ভিডিও করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া দরকার।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, শুধু সাধারণ মানুষজন নন, অনেক উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা আসেন এই হাসপাতাল দেখার জন্য। তারা ভেতরে ঢুকেই রোগীদের সঙ্গে ছবি তোলা বা ভিডিও নিতে চান। এটা অনৈতিক এবং রোগীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণের শামিল।
তিনি আরও বলেন, দেশের কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে লোকজন ভিজিট করতে যান বা গিয়ে রোগীর সঙ্গে ফটোসেশন করতে চান। এখানেই ব্যতিক্রম। এটা সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই বন্ধ করা সম্ভব।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাবেক আবাসিক চিকিৎসক ও নওগাঁ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মনোরোগবিদ মাসুদ রানা সরকার বলেন, মানসিক হাসপাতালে দর্শনার্থীদের প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও সেখানে ঢুকে রোগীদের সঙ্গে অনেকেই দুষ্টুমি করেন, চিড়িয়াখানার বন্দি বানর-হনুমানের মতো আচরণ করেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের বিড়ি-সিগারেট দেন। তাদের দিয়ে গান গাওয়ানো বা বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা বলিয়ে ভিডিও করা চরম অমানবিক আচরণ। এতে তাদের অসুস্থতা বেড়ে যেতে পারে।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আহসান আজিজ সরকার বলেন, হাসপাতালটির আয়তন বিশাল। অনেক অংশে নিরাপত্তা দেওয়াল নেই। তাই বহিরাগতদের আগমন সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, এই রোগীরাও তো সমাজের অন্য দশজনের মতোই মানুষ। তাদের ভিন্ন চোখে দেখা বা তাদের নিয়ে বিনোদন বা ব্যবসা করার মানসিকতা নিন্দনীয় কাজ। এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত একটি জায়গার ছবি বা ভিডিও বিনা অনুমতিতে নেওয়া অপরাধ। সবার সহযোগিতা পেলে এসব বন্ধ করা সম্ভব।
আহসান আজিজ সরকার বলেন, কোনো আনসার সদস্য টাকা নিয়ে দর্শনার্থী প্রবেশ করালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআরআর/জেআইএম