হরতাল-অবরোধে মাঠে কৃষকের কান্না

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৮:২৬ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২৩

<> বাজারজাতকরণের অভাবে আগাম সবজি চাষিরা বিপাকে
<> ক্ষেতের তিনগুণ বেশি দাম খুচরা বাজারে
<> উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে সংশয়

বগুড়ায় হরতাল-অবরোধে মাঠ পর্যায়ে কমে গেছে শীতকালীন সবজির দাম। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এসব সবজি বাজারজাত করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা। তারা বলছেন, লাভের আশায় বেশি দামে সার-বীজ কিনে আগাম চাষ করেছি। এখন মাঠে যে দামে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে লস করা ছাড়া উপায় নেই।

সোমবার (১৩ নভেম্বর) উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ সবজিহাট মহাস্থানে ১০০ টাকা ধরা (৫ কেজি) বরবটি, ২১৬-২২০ টাকা ডজন সাচি লাউ এবং ১২৫ টাকা ধরা বেগুন বিক্রি হয়েছে। এছাড়া এ হাটে মুলা মিলেছে প্রতি ধরা ৭৫ টাকায়। প্রতি মণ ফুলকপি ১০০০-১২০০ টাকা, শসা ৫০০, ঝিঙে ১০০০, পেঁপে ৩৫০, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ৮০ এবং ১০০ ও বাঁধাকপি ২০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

jagonews24

হাটের এ চিত্র হলে মাঠের অবস্থা কী? জানতে শিবগঞ্জের আঁচলাই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে চাষির হা-হুতাশ। সেখানে মাঠে নিজের স্ত্রী ও পুত্রবধূকে নিয়ে মুলা ও ফুলকপি তুলছিলেন আমিরুল হক। বললেন, লাভের আশায় আগাম চাষ করেছি। বাজারও ছিল ভালো। এখন অবরোধে পাইকাররা সবজি কিনছেন না। স্থানীয় ফড়িয়ারা নামমাত্র দামে জমি থেকে সবজি নিয়ে যাচ্ছেন।

আমিরুল হক সোমবার ক্ষেত থেকে মুলা বিক্রি করেছেন প্রতিমণ ৩৫০-৪০০ টাকায়। অথচ এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে হাজারের ওপরে। ১০০ ফুলকপি বিক্রি করছেন ৭০০-৭৫০ টাকায়, যা আগে ছিল ১৫০০ টাকার ওপরে। দেখা গেলো পাশের ডোবার পানিতে আমিরুলের স্ত্রী ও পুত্রবধূ মুলা ধুয়ে পরিষ্কার করছেন। এটা করলে কেজিতে দাম ১-২ টাকা করে বেশি পাওয়া যাবে।

jagonews24

চাষিরা জানান, এবার শীতকালীন সবজির চারা ৪-৫ গুণ বেশি দামে তাদের কিনতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেশি হয়েছে। ভালো দামে এসব সবজি বিক্রি করা না গেলে লোকসান গুনতে হবে।

ফজলু মিয়া নামের একজন চাষি বলেন, গতবছর প্রতি হাজার মরিচের চারা ২০০-৩০০ টাকা পাওয়া গেলেও এবার তা বেড়ে হয়েছে ১৪০০ টাকা। এছাড়া সার, কীটনাশক ও সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

মহাস্থানহাটের আড়তদার আল-আমিন সরকার বলেন, ‘বাজার ভালোই ছিল। এখন অবরোধের কারণে সবজির ট্রাক বাইরে যাচ্ছে না। দু-একজন রিস্ক নিলেও ভাড়া চাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। যে কারণে হাটে আমদানি প্রচুর হলেও বিক্রি না হওয়ায় কমে যাচ্ছে বাজারদর। অতিরিক্ত লোকসানের ভয়ে অনেকে ফড়িয়াদের কাছে জমিতেই সবজি বিক্রি করে দিচ্ছেন।’

হাটের মধ্যে সাচি লাউ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন চাষি আকবর আলী। বললেন, ‘হরতাল-অবরোধ হলেই আমাদের লোকসান গুনতে হয়। দুই বিঘা জমিতে লাউ ও মুলা চাষ করেছি। সপ্তাহখানেক ধরে বাজারে মুলা বিক্রি করছি। এখন লাউ এনেছি। আমার একটি লাউয়ে খরচই আছে ১০ টাকার ওপরে। এখন হাটে এসে সেই লাউয়ের দাম বলছে ৭০০ টাকা (প্রতি ১০০)। এখানে গাড়ি ভাড়া ও আমার শ্রমের মূল্য গেলো কোথায়?’

নাজিম উদ্দিন নামের আরেক চাষি বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ হতেই পারে। আমরা কৃষক। আমাদের শস্য ছাড়া মানুষ অভুক্ত থাকবে। তাহলে আমাদের পণ্য সরবরাহে এত ঝুঁকি থাকবে কেন। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে আমরা উৎপাদন খরচের টাকাই তুলতে পারবো না।’

আঁচলাই গ্রামের কৃষক মোতাহার আলী বলেন, ‘সবজি চাষে লাভ বেশি। এখন ভর বছর সবধরনের সবজি ফলানো যায়। ফলনে কম সময় লাগে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে জমি ফেলে রাখতে হবে।’

মহাস্থান হাট থেকে সবজি নিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন ট্রাকচালক মনির মিয়া। তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে মালিক রাজি হন না। আমরা থাকি ভয়ে। যে কারণে মহাসড়কে গাড়ি কম, ভাড়া বেশি।

jagonews24

তবে হাটে ও মাঠে সবজির দরের এ অবস্থা হলেও খুচরা বাজারে ঠিকই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। সোমবার শহরের ফতেহ আলী বাজারে কাঁচা মরিচ প্রতিকেজি ১২০ টাকা, গোল বেগুন ৭০, লম্বা বেগুন ৬০, ঢ্যাঁড়শ ৫০, করলা ৭০, মুলা ৪৫, বরবটি ৬০, পটোল ৫০, ঝিঙে ৬০, ফুলকপি ৫০, পেঁপে ৩০, সাচি লাউ প্রতিটি ৪০-৫০, লাল পাকড়ি আলু ৬৫, সাদা অ্যাসটরিক আলু ৫০ এবং পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, বগুড়া অঞ্চল সবজি আবাদে বড় ভূমিকা রাখছে। এখানে সবজি আবাদে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এর বাইরে কৃষক নিজ উদ্যোগে বাড়তি সবজি আবাদ করেন। ২০২১ সালে সবজির আবাদের টার্গেট করা হয় চার হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমি। পরবর্তী বছরে তা বেড়ে হয় ছয় হাজার ৪৮০ হেক্টর। এবার ওই টার্গেট বেড়ে হয়েছে আট হাজার হেক্টরেরও বেশি।

তবে হরতাল-অবরোধের কারণে কৃষক তাদের পণ্য বাজারজাত করতে না পারায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।