কাঁসা-পিতল শিল্পের দুর্দিন

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৬:৫৬ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

একটা সময় দিনরাত ব্যস্ততা থাকতো শরীয়তপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পীদের। দূর থেকে কান পাতলে শোনা যেতো তাদের হাতুড়ির টুংটাং ধ্বনি। তবে দিন দিন কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য বাজার দখল করায় ধ্বংসের মুখে শিল্পটি।

চার দশক আগে গড়ে ওঠা দেড়শো কারখানা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র চারটিতে। কাঁসারুদের আশঙ্কা, দ্রুত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এ শিল্প বিলীন হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকে শরীয়তপুরের কাঁসা-পিতল শিল্পের সুখ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। একসময় কাঁসা-পিতলের নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরিতে দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন এখানকার শিল্পীরা। এখানকার তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, কলস, থালা, বাটি, গ্লাস, বালতি, পানদানি বিক্রি হতো রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার হাট-বাজারে। জেলার সদরের গ্রাম পালং, বাঘিরা, বিলাশখান ও দাসার্তা এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত দুই শতাধিক কারখানায় পাঁচ শতাধিক পরিবার এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো।

বংশ পরম্পরায় চলে আসা একসময়ের এ ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। নানা কারণে কাঁসা-পিতলের শিল্পীদের অনেকেই চলে গেছেন ভারতে। অনেকেই করেছেন পূর্ব পুরুষদের পেশা পরিবর্তন। বর্তমানে দাসার্তা এলাকার ইদ্রিস চৌকিদার, সেন্টু চৌকিদার, নুরুল হক ও মোক্তার কাজী—এ চারটি পরিবার শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছে।

দাসার্তা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানায় কাঁসা কারিগরদের তেমন কোনো কাজের চাপ নেই। কেউ বালতি তৈরি করছেন, কেউ আবার শৌখিন কলসের তলা বানাচ্ছেন। একজনকে দেখা গেলো আগুনের সাহায্যে কাসার পাতকে নরম করছেন।

বর্তমানে দাসার্তা এলাকায় এ শিল্পটিকে যে চারজন টিকিয়ে রেখেছেন তাদের মধ্যে একজন ইদ্রিস চৌকিদার। তার বাবা জুলমত চৌকিদার অন্তত শত বছর আগে কারখানাটি গড়ে তোলেন। সেসময় কারখানাটিতে ৩০ জন কারিগর কাজ করতেন। জুলমত চৌকিদারের মৃত্যুর পর তার ছেলে ইদ্রিস চৌকিদার ৩০ বছর ধরে কারখানাটি পরিচালনা করছেন। কাজের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন মাত্র চারজন কারিগর রয়েছেন এ কারখানায়।

কাঁসা-পিতল শিল্পের এমন দৈন্যদশা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আগের মতো কেউ কাসা পিতলের জিনিস কিনতে চায় না। কাঁসা পিতলের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বেশি দামে কিনতে হয় এবং বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। বাজারে এখন অল্প দামে প্লাস্টিকসহ নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। লোকজন তাই বেশি দাম দিয়ে কাঁসা-পিতলের জিনিস কেনে না। তাছাড়া মূলধন কমে যাওয়ায় ব্যবসায় এখন বেশি ইনভেস্ট করতে পারছি না। সরকার থেকে যদি আমাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো, তাহলে শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।’

ইদ্রিস চৌকিদারের কারখানায় ৪০ বছর ধরে কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র বানানোর কাজ করছেন আলী আজম ঢালী। বাংলাদেশের তৈরি কাঁসা-পিতলের জিনিসের কদর কমে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাঁসা-পিতল তৈরির কাঁচামাল ভারতে চলে যায়। ভারতে নতুন নতুন প্রযুক্তির মেশিন রয়েছে, সেখানে স্বল্প খরচে জিনিসপত্র বানিয়ে বাংলাদেশে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। সেসব জিনিসের দাম অনেক কম হয়। আমরা সনাতন পদ্ধতিতে কাঁসা-পিতলের জিনিস বানাই। তাই আমাদেরটা বেশি মজবুত হয় কিন্তু খরচ বেশি পড়ে। লোকজন তাই কম দামে ভারতের তৈরি কাঁসা-পিতলের জিনিস কেনে। আমাদের কাঁচামাল যদি ভারতে চলে না যেতো, আমরাও স্বল্পদামে বিক্রি করতে পারতাম।’

তাইজুল ইসলাম নামের আরেক কারিগর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জিনিস তৈরি করার ওপরে মজুরি পাই। এখন কাজ কমে যাওয়ায় আমাদের মজুরিও কম। সারাদিন কাজ করে ৪০০-৫০০ টাকা পাই। এ দিয়ে সংসার আর চলে না। তাই ছেলেদের অন্য পেশায় দিয়ে দিয়েছি। ভাবছি এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে গরু পালন করবো।’

স্থানীয় বাসিন্দা কবির হোসেনের একসময় নিজের কাঁসা-পিতলের কারখানা ছিল। পরে তা বিক্রি করে মালয়েশিয়া চলে যান। সম্প্রতি দেশে ফিরে এসে একটি মুদিদোকান পরিচালনা করছেন।

কবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের এ এলাকায় একসময় দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব হতো না। টুংটাং শব্দে কানে তালা পড়ে যেতো। আমার বাবা কাঁসা-পিতলের কাজ করেছে, আমি নিজেও করেছি। একসময় কাজ কমে যাওয়ায় সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ে। তখন কারখানা বন্ধ করে বিদেশ চলে যাই। এখন বিদেশ থেকে ফিরে এসে মুদিদোকান দিয়েছি।’

তবে এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখার আশ্বাস দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন।

তিনি বলেন, কাঁসা-পিতল শিল্প আমাদের ঐতিহ্য। এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারিগরদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারিভাবে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলে তাদের তা দেওয়া হবে।

বিধান মজুমদার অনি/এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।