হাট-বাজার ইজারায় টাকার খেলার বলি ক্রেতা-ব্যবসায়ী

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৪:২৬ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২৪
বগুড়ার একটি হাটের চিত্র

বগুড়ার গ্রামগঞ্জের হাটগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অসম দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছেন ক্রেতা ও হাটুরেরা (ব্যবসায়ী)। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে হাটগুলো ইজারা নিচ্ছেন তারা। এতে সরকারি রাজস্ব বাড়লেও তার বোঝা পড়ছে ক্রেতা ও হাটুরেদের কাঁধে। নির্ধারিত খাজনার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছেন তারা।

গতবছর (বাংলা ১৪৩০ সন) জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ওমরপুরহাট এক কোটি ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছিলেন শেরপুরের শেনু ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম। এবার (বাংলা ১৪৩১) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেই হাট দুই কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় নিয়েছেন শহরের বাদুরতলা এলাকার এমবি এন্ট্রারপ্রাইজের পার্টনার আওয়ামী লীগ নেতা কানাইলাল ময়না। নির্ধারিত এ মূল্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ভ্যাট/ট্যাক্স মিলিয়ে ২৫ শতাংশ টাকা যোগ হবে।

নন্দীগ্রাম পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই হাটে সরকার নির্ধারিত দর ছিল এক কোটি ৫৫ লাখের কিছু ওপরে। সেখানে অসম প্রতিযোগিতার কারণে আমরা ৭০ লাখেরও বেশি টাকা পেয়েছি। এটা সরকারি রাজস্বর জন্য ভালো। তবে ইজারাদার যাতে বেশি টাকা খাজনা আদায় করতে না পারেন সে বিষয়ে আমরা নজর রাখবো।’

অন্যদিকে শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল নামে হাটটি গতবারের চেয়ে ৬০ লাখ টাকা বেশি দিয়ে ৮১ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি সাজেদুর রহমান শাহীন। গতবছর হাটটির সর্বোচ্চ ডাক উঠেছিল ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

ব্যত্যয় ঘটেনি জেলার অন্যতম বৃহৎ পশুরহাট মহাস্থানেও। বাংলা ১৪৩০ সনের চেয়ে ১৪৩১ সনের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা বেশি দিয়ে হাটটি ইজারা নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর শ্যালক শফিকুল ইসলাম।

যেখানে আগের বছরগুলোয় কম মূল্যে হাট ইজারা নিতে সিন্ডিকেট করা হতো, এবার মাত্রাতিরিক্ত মূল্যে ইজারা নেওয়ায় এর প্রভাব হাটুরেদের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর বাড়তি খাজনা গুনতে গিয়ে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে বলছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। হাটের ইজারা নিয়ে নিজেদের নেতাকর্মীদের মধ্যেকার কামড়াকামড়ি এখন ওপেন সিক্রেট। হাটে কী মধু আছে তা বলতে না পারলেও এটা বুঝি যে, লস করে কেউ হাট নেবে কেন? এই বাড়তি টাকা সাধারণ কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে পড়বে।’

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবার গতবছরের চেয়ে গড়ে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেশি মূল্যে ২৫৪টি হাট-বাজার ইজারা দিতে পৃথকভাবে দরপত্র আহ্বান করে উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে রয়েছে ৬৭টি পশুরহাট। ধান ও শাকসবজির হাট ২৬টি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পশু, ধান এবং সবজির হাটের ওপরই নজর থাকে ইজারাদারদের সবচেয়ে বেশি। এক বছর মেয়াদের এসব হাট-বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে ইজারা নেওয়ার ঘটনাও আছে। এমনকী লস হচ্ছে এমন অজুহাতে মামলা করে হাটের অতিরিক্ত ইজারা প্রদান বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে। ১০ বছর আগে বগুড়া সদরের ঘোড়াধাপ হাটটির ডাক উঠেছিল ৪৮ লাখ টাকা। তিন বছর পর ২০১৫ সালের দিকে ওই হাটটির ডাক ৩৫ লাখ টাকার ওপরে ওঠেনি সিন্ডিকেটের কারণে। পরবর্তী সময়ে হাটটি ৩০ লাখ টাকায় ইজারা দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন।

একই মূল্যে পরপর চার বছর হাটটি ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছর আগে প্রশাসনের কঠোরতার কারণে প্রতিযোগিতা বাড়ায় প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ টাকার বেশি হাটটির ডাক উঠতে থাকে। গতবছর (বাংলা ১৪৩০) ইজারা দেওয়া হয় প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে ৭০ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৩ টাকায়।

অভিযোগ আছে, গতবছরও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেশ কিছু হাটের ইজারা নেওয়া হয়েছিল। হাট ইজারাকে কেন্দ্র করে জেলার শাজাহানপুর উপজেলায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। হাটের শিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগে জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। আগে সিন্ডিকেট করে হাট-বাজার ইজারা নেওয়া হলেও মূলত গতবছর থেকে নিজেদের মধ্যেই বিরোধ তৈরি হয়। যে কারণে এবার আর সিন্ডিকেট হয়নি। যে যার মতো করে হাটের ডাক দেন। তারা বাড়তি এ টাকা উশুল করছেন হাটের অতিরিক্ত খাজনা থেকে।

শাজাহানপুর উপজেলায় ২২টি হাট-বাজার (বাংলা ১৪৩১ সালের জন্য) ইজারা দিতে প্রশাসন ৩ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে। এতে জেলা স্বেচ্ছসেবক লীগের সভাপতি ভিপি সাজেদুর রহমান শাহীন ২১ লাখ ৮০ হাজার ২৩৪ টাকা মূল্যের নয়মাইলহাটটি ৮১ লাখ ২৩ হাজার টাকা, ৩৮ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের দুবলাগাড়ি হাটটি ৮১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা মূল্যের জামাদারপুুকুর হাটটি এক কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মূল্যের কাহালু উপজেলার জামগ্রাম হাটটি এক কোটি ৩৩ লাখ ২২ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছেন। হাটের এ মূল্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে ২৫ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স।

এ বিষয়ে ভিপি সাজেদুর রহমান শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করি। হাটের মূল্য বেশি হলেও আমার লস হবে না জেনেই নিয়েছি। হাটের উপযুক্ত দাম ওঠায় সরকারের রাজস্ব বেড়েছে।’

তবে তিনি দাবি করেন, টোল বা খাজনা আগের চেয়ে বাড়বে না। বাড়ি থেকে ফসল বেচাকেনায় খাজনা দিতে হবে না।

তবে ভিন্ন কথা বলেন জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি এবং খড়না ও আতাইল হাটের ইজারাদার আলহাজ শেখ। তার মতে, যারা বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে হাট-বাজার ইজারা নিয়েছেন তারা অবশ্যই টাকা তুলতে টোল বা খাজনা বাড়িয়ে দেবেন। তাতে করে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে।

বগুড়া সদরের নামুজা হাটটি গতবছর ইজারা দেওয়া হয়েছিল ৭৫ লাখ টাকায়। এবার এক কোটি ৭৭ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন চকসূত্রাপুর এলাকার এমবি এন্ট্রারপ্রাইজের কর্ণধার যুবলীগ নেতা আব্দুল মতিন সরকার।

মহাস্থান ছাড়াও শিবগঞ্জ উপজেলার আরেকটি বড় হাট মোকামতলা হাট এক কোটি ৬০ লাখ টাকায় ইজারা নেন সংসদ সদস্য রিপুর শ্যালক শফিকুল ইসলাম। গতবছর হাটটি ইজারা দেওয়া হয়েছিল এক কোটি ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪১০ টাকায়।

এদিকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনো নতুন বছরের খাজনা আদায় শুরু না হলেও আগে থেকেই হাটুরে, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি জমি থেকে আলু বিক্রি করায় শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর এলাকায় কৃষকদের বাড়ি থেকে খাজনা আদায় করা হয়। সেখানকার শাহনগর এলাকার শাকসবজি উৎপাদন করা কৃষকরা বাড়িতে বসে সবজি বিক্রি করলেও খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য হন তারা। এমনকি গরু-ছাগল বাড়িতে বিক্রি করলেও উভয়কেই খাজনার আওতায় এনেছেন ইজারাদাররা।

হাট এলাকা দিয়ে কোনো পণ্যবাহী ট্রাক গেলে তা থামিয়ে ইজারাদারদের লোকজনদের ট্রাকপ্রতি কমপক্ষে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নিতে দেখা যায়। ২১ ফেব্রয়ারি শাজাহানপুরের আড়িয়াহাট এলাকার ওপর দিয়ে আলুবোঝাই একটি ট্রাক ঢাকায় যাওয়ার সময় ইজারাদারদের লোকেরা ট্রাক থামিয়ে চাঁদা নেন। পরে অভিযোগ পেয়ে র্যাব সদস্যরা তিন চাঁদাবাজকে হাতেনাতে আটক করেন। মহাস্থান হাটেও শাকসবজির ট্রাকপ্রতি হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

বেশি মূল্যে হাট ইজারা নেওয়ায় আসছে কোরবানির পশুরহাটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন পশু ব্যবসায়ীরা। তাদের ধারণা, গতবছরের চেয়ে গরু-ছাগল বেচাকেনায় দ্বিগুণ খাজনা গুনতে হবে। হাটের খাজনা বা টোল বাড়ায় পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

আমিনুল নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ওমরপুরহাটে ২৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ইজারা মূল্য পড়েছে দুই কোটি ৮১ লাখ ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা। যা গতবছরের চেয়ে এক কোটি ২৭ লাখ টাকা বেশি। আসল টাকা তুলতে হলে ইজারাদারকে প্রতি হাটে খাজনা তুলতে হবে কমপক্ষে দুই লাখ ৭০ হাজার ৩২১ টাকা। লাভ করতে হলে এর বাইরে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের বিষয় তো রয়েছেই।

সরকারের চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে ওমরপুরহাট ইজারা নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতা কানাইলাল ময়না বলেন, প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বেশি দামে হাট ইজারা নিতে বাধ্য হয়েছি। তবুও হাটে লোকসান হবে না। তবে হাটুরেদের কাছ থেকে বেশি খাজনা নেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিদা আক্তার বলেন, বেশি দামে হাট-বাজার ইজারা নেওয়ায় সরকারের রাজস্ব বাড়ছে। তবে টোল বা খাজনা যাতে বাড়াতে না পারে সেজন্য প্রতিটি হাটে টোল বা খাজনার চার্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সেই চার্ট অনুয়ায়ী খাজনা নিতে হবে। বেশি নিলে ইজারা বাতিল করা হবে। পণ্যের দামও বাড়ানো যাবে না।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু বলেন, আগে হাট সিন্ডিকেট করে ইজারা নেওয়া হতো। যে কারণে হাটের উপযুক্ত মূল্য পায়নি সরকার। এবার সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক ডাক হয়েছে। এতে মূল্য বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার নাম প্রচার করে হাট নেওয়া হলেও মূলত হাট চালায় আমার শ্যালক।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, সরকারের চাহিদার চেয়ে বেশি মূল্যে হাট-বাজার ইজারা নিলে এর প্রভাব হাটুরেদের ওপর পড়তে পারে। কারণ যারা বেশি মূল্যে হাট নিচ্ছেন তারা টাকা তুলতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করবেন। তবে আমরা এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা রাখবো।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।