সুদিন ফেরেনি ব্যবসা-বাণিজ্যে

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৫৯ এএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের মতো ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশাও ছিল বিপুল। পতিত সরকারের সময় দীর্ঘদিনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সৃষ্ট জটিলতা কাটিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সুদিনের প্রত্যাশা করেছিলেন তারা।

সরকারের ছয় মাস পূর্তির সময়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের ব্যবসা পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি, বরং কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। দেশে কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নেই। জিডিপির তুলনায় বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ কম। পাশাপাশি ডলারের দাম চড়া হওয়ার কারণে পণ্য আমদানি কমেছে। এসব ক্ষেত্রে এখনো কোনো দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদহার কমানো নিয়েও কোনো পদক্ষেপ নেই। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও নষ্ট করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ অনেকের।

বিজ্ঞাপন

চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে অন্তর্ববর্তী সরকারের শতাধিক পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ ব্যবসায় দারুণ নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। এতে বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। কমে গেছে পণ্যের কেনাবেচা। পাশাপাশি দেশের বেশকিছু পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে খরচ বাড়ায় কমেছে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা।

ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও আমদানি কম

বিগত সরকারের শেষ সময় থেকে বিনেয়োগ পরিস্থিতি খারাপ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সে দুরবস্থা কাটেনি। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার বেশ কম। ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির এই হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

প্রথমত নতুন সরকার এ ছয় মাসে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি ও সুরক্ষা দিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে যারা রয়েছে, এটি দেশ ও বিদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে।- আইবিএফবির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন রশীদ

ফলে ব্যাংকগুলো অর্থসংকটে ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগও বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) খরা কাটেনি। উল্টো অবনতি হয়েছে নতুন সরকারের আমলে। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৭১ শতাংশ কম।

আরও পড়ুন

ঋণ নেই, নেই নতুন বিনিয়োগ। এতে মন্দা চলছে আমদানিতেও। গত ছয় মাসে আমদানি আগের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। খারাপ চিত্র নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যা বলছেন ব্যবসায়ীরা

দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নতুন সরকারের নীতি সমন্বয়ের অভাব মন্তব্য করে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সাবেক সভাপতি ও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হুমায়ুন রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমত নতুন সরকার এ ছয় মাসে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি ও সুরক্ষা দিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে যারা রয়েছে, এটি দেশ ও বিদেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে।’

সুদিন ফেরেনি ব্যবসা-বাণিজ্যে

দ্বিতীয়ত, সার্বিক অর্থনীতির সংস্কারের গতি এখনো মন্থর। যেটা অনেক ত্বরান্বিত হবে বলে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল। এরপর, বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছে, সেটা কিন্তু সরকারের নীতি সমন্বয়ের অভাবে ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে। কিংবা তারা (সরকার) সে বিষয়ে মনোযোগী ছিল না। যে কারণে বর্তমানে দেশের ব্যবসায়ীরা আস্থার অভাবে ভুগছেন।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘এ সময়ে ঋণ সরবরাহ অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে এসেছে। কেউ নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, ঠিকঠাক ব্যবসা করতে পারছে না। নতুন বিনিয়োগ আসছে না। এতে কিন্তু কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। জেন-জির জন্যও কিন্তু সরকার নতুন কর্মসংস্থান করতে পারেনি।’

হুমায়ুন রশীদ বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যাংক লোনের উচ্চ সুদের হার আরেক বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা। সেটাতে ভালো করতে পারেনি এ সরকার। সেসব কারণে ব্যবসার খরচ ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কমেছে পণ্যের বেচাকেনা। এর মধ্যে আবার শুল্ককরের একটি বড় বোঝা চেপেছে। সেটা করার সময় কোনো চিন্তা-ভাবনা বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথাও বলা হয়নি। সবকিছু মিলে ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে নেই।’

এ সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের মতো ব্যবসায়ীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। তবে সে হিসাব এখন মিলছে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক সংস্কার প্রত্যাশা ছিল, সেটা হয়নি। বড় কোনো সংস্কারের তেমন কোনো উদ্যোগও আমরা দেখিনি।- টিভিএস অটো বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায়

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুরূহ ছিল। বিগত অভিজ্ঞতা বলে যে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রাথমিক প্রভাব পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।’

বিজ্ঞাপন

‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে প্রথম তিন মাসে অনেক উৎপাদন ও রপ্তানিনির্ভর কল-কারখানা ঠিকঠাক চলতে পারেনি। তখন যে পরিমাণে উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে, তাতে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা।’

তিনি বলেন, ‘এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকারকরা এলসি করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। শিল্পে গ্যাসের সরবরাহও বিঘ্নিত হয়েছে, যার প্রভাবে উৎপাদন কমেছে। পাশাপাশি এনার্জির মূল্যবৃদ্ধি ও ভ্যাটের চাপে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে।’

আসিফ ইব্রাহিম বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। ব্যক্তিখাত সঙ্গে নিয়ে এই দুরূহ অবস্থান থেকে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলে এসব সমস্যা সমাধানযোগ্য।’

বিজ্ঞাপন

সুদিন ফেরেনি ব্যবসা-বাণিজ্যে

টিভিএস অটো বাংলাদেশের সিইও বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ‘এ সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের মতো ব্যবসায়ীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। তবে সে হিসাব এখন মিলছে না। ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক সংস্কার প্রত্যাশা ছিল, সেটা হয়নি। বড় কোনো সংস্কারের তেমন কোনো উদ্যোগও আমরা দেখিনি।’

তিনি বলেন, ‘এখনো ডলারের দাম অস্থিতিশীল। ব্যাংকগুলো ঠিকঠাকমতো এলসি দিতে পারছে না। পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য নতুন সরকার দৃশ্যমান কিছুই করেনি। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। তাদের ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১৬-১৭ শতাংশে চলে যাচ্ছে। আর এখন কেউ ঋণ পাচ্ছে না।- নাসিব সভাপতি মির্জা নুরুল গণি শোভন

ক্ষদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও স্বস্তিতে নেই বলে জানিয়ে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিব) সভাপতি মির্জা নুরুল গণি শোভন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য নতুন সরকার দৃশ্যমান কিছুই করেনি। ছোট ছোট উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। তাদের ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১৬-১৭ শতাংশে চলে যাচ্ছে। আর এখন কেউ ঋণ পাচ্ছে না।’

এই জাঁতাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান বিগত সরকারের আমলেও বন্ধ ছিল। এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো কাজ করতে পারছে না, শিল্পগুলো বন্ধ, শ্রমিকরা বেকার।’

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

নুরুল গণি আরও বলেন, ‘আমাদের এ সেক্টরে নজর খুব জরুরি। না হলে এ খাত সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে, জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান ক্রমাগত কমছে, শূন্য হয়ে যাবে।’

এনএইচ/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।