ট্যানারি শিল্প বেপজার অধীনে নেওয়া নিয়ে মালিক-শ্রমিকদের উদ্বেগ
দেশের ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেজপা) অধীনে নেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এ খাতের প্রতিষ্ঠানের মালিক-শ্রমিকরা। মালিকরা বলছেন, ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অধীনে থাকা অবস্থায় তারা ৯৯ বছরের জন্য জমি লিজ পেয়েছেন। কিন্তু বেপজার অধীনে গেলে ৩০ বছরের জন্য জমি ভাড়া নিতে হবে। মালিকানা ছেড়ে ভাড়ার শর্তে মালিকরা বেপজার অধীনে যেতে আগ্রহী নন।
শ্রমিকরা বলছেন, বেপজার অধীনে গেলে শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার হারাতে হবে। যদিও বেপজার অধীনে গেলে ন্যূনতম মজুরি পাবে সব শ্রমিক। বেপজার অধীনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে মালিক-শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি মতামত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর সাত মসজিদ রোডের ফোর সিজন রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীকে বিসিকের আওয়াতা থেকে বেপজার অধীনে নিতে সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে এ বৈঠক হয়।
অনুষ্ঠানে লেদার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এলডিপি) কো-অর্ডিনেটর ফিরোজ আলম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এলডিপি প্রজেক্টের কোঅর্ডিনেশন টিমের সদস্য তাহেরুল আলম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাখাওয়াত উল্লাহসহ ট্যানারি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
মূল প্রবন্ধে তাহেরুল আলম বলেন, দেশের ট্যানারি শিল্প নানান চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে বর্তমানের অবস্থায় এসেছে। আগের সরকারের সময় লেদার ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল- লেদার সেক্টরের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। আলোচনা চলছিল, মন্ত্রণালয়ও কাজ করছিল।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর নতুন প্রস্তাব আসে ট্যানারি শিল্পকে বেপজার নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হতে পারে। এ নিয়ে একটি উচ্চস্তরের কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি প্রস্তাবের সুবিধা-অসুবিধা দেখে প্রতিবেদন দেবে। প্রথমে এক মাস সময় দেওয়া হলেও জটিলতা বাড়ায় সময় বাড়িয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। ওইদিন প্রতিবেদন জমা পড়বে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে শিল্পটি বেপজার অধীনে যাবে কি যাবে না।
আরও পড়ুন
অবশেষে সয়াবিন তেলের দাম বাড়লো ৬ টাকা
আর কতদিন পর নিজের টাকা তুলতে পারবো, প্রশ্ন ৫ ব্যাংকের গ্রাহকদের
তাহেরুল আলম আরও বলেন, আমরা মালিকদের মতামত জানতে একটি কনসালটেশন ওয়ার্কশপ করেছি। মালিকরা বলেছেন- বিসিক ও ব্যবসার নীতির মধ্যে বড় পার্থক্য আছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, বিসিকে জমি ৯৯ বছরের লিজ পাওয়া গেছে, কিন্তু বেপজায় মাত্র ৩০ বছরের জন্য ভাড়া। এতে তাদের কোনো মালিকানা থাকে না। এছাড়া ইটিপির চার্জ বিসিকে ৪০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বেপজায় আউটসোর্সিংয়ের কারণে তা ২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এতে ছোট ট্যানারিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও টিকে থাকতে পারবে না।
তিনি বলেন, শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ দেখা গেছে। বেপজার আওতায় গেলে শ্রম আইন কার্যত বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, বেপজার নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। এতে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার ও ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন সীমিত হয়ে যাবে। তারা এসব অধিকার উপভোগ করতে পারবে না। যদিও কেউ কেউ বলছে- ইনডিভিজুয়াল লেভেলে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব সিদ্ধান্তের সঠিক বাস্তবায়ন এখনো নিশ্চিত নয়।
অনুষ্ঠানে ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, সাভারের ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অধীনে থাকা অবস্থায় আমরা সেখানকার জমি ৯৯ বছরের লিজ পেয়েছি। কিন্তু বেপজায় পাবো ৩০ বছরের জন্য ভাড়ায়। কেউ কি মালিকানা ছেড়ে ভাড়ার চুক্তিতে যেতে রাজি হবে? সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আরও আলোচনা হওয়া দরকার। স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী আমিনুল হাসান বলেন, ট্যানারি শিল্প বিসিক থেকে বেপজায় যাবে কি না সে বিষয়ে টেকটিক্যাল কমিটি করতে হবে। কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী সাভারের ট্যান্যারি পল্লি যাবে কি যাবে না- সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে উচ্চ পর্যায়ে যে কমিটি কাজ করছে সেখানে টেকনিক্যাল লোক খুবই কম। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে ট্যানারি মালিকদের কথা শুনতে হবে।
বক্তরা আরও বলেন, হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের ফলে অসংখ্য শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। ২ ডলারের চামড়া এখন ৮০ সেন্টে বিক্রি করি। নতুন করে সাভারের ট্যানারি এক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আরেক কর্তৃপক্ষের হাতে গেলে আগের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
তারা আরও বলেন, একটি টেকনিক্যাল টিম গঠন করা যেতে পারে, যারা পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করবে। মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষের মতামত যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৭ সালের মতো অপরিকল্পিত কোনো সিদ্ধান্ত যেন না আসে। সবার কথা শুনে প্রয়োজন হলে যথাযথ ও পরিকল্পিতভাবে এক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অন্য কর্তৃপক্ষের অধীনে নেওয়া হোক।
ইএইচটি/কেএসআর