এলজিইডি’র আবদার ৩৬টি জিপ-পিকআপ ভ্যানের, পেল মাত্র তিনটি

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৫৫ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
সংগৃহীত ছবি

একটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২৯টি পিকআপ ভ্যান এবং ৭টি জিপ কেনার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন এলজিইডি’র প্রস্তাব অযৌক্তিক মনে করে মাত্র তিনটি জিপ কেনার প্রস্তাব রেখে বাকিটা বাতিল করেছে। ‘উপকূলীয় শহর জলবায়ু সহিষ্ণু’ প্রকল্পের আওতায় এমন প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও উপকূলীয় ২২টি পৌরসভা। প্রকল্পের এসব ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় যানবাহনের সংখ্যা ও পরামর্শক ব্যয় কমানো হবে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিত কর্মকারের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটির জন্য ২৫২ জন জনবলের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর বিপরীতে অর্থ বিভাগ ৬৫ জন জনবল মঞ্জুর করেছে। এছাড়াও প্রকল্পের জন্য ২৯টি পিকআপ ভ্যান এবং ৭টি জিপ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থ বিভাগ হতে মাত্র তিনজন ড্রাইভার মঞ্জুর করা হয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের কাজে তিনটি জিপ কেনা যেতে পারে। ফলে জনবল ও যানবাহন খাতে প্রকল্পের অর্থ সাশ্রয় হবে।

প্রকল্পের জনবল, গাড়ি, পরামর্শক ব্যয় ছাড়াও জ্বালানি, মেরামত, স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার, সেমিনার, প্রকৌশল যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন রাজস্ব ও মূলধন খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে। একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যয় যৌক্তিকীকরণ কমিটির মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিক করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে একত্রে বসে প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সাশ্রয়কৃত অর্থ প্রকল্পের জিওবি অংশ হতে বাদ দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

এলজিইডি প্রকল্পের আওতায় সাতটি জিপের আবদার করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। ফলে প্রতিটি জিপের দাম পড়বে এক কোটি করে। ২৯টি ডাবল কেবিন পিকআপ চাওয়া হয়েছে। যার প্রতিটির দাম পড়বে প্রায় ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া ২৪টি মোটরসাইকেল কেনার কথা বলা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ফলে প্রতিটি মোটরসাইকেলের দাম পড়বে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। দুটি মাইক্রোবাস কেনার কথা বলা হয়েছে, যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সবকিছু বাদ দিয়ে মাত্র তিনটি জিপ রাখা হয়েছে।

ওই প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১৪৩ কোটি ৪১ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট পরামর্শক সংখ্যা ৪ হাজার ৫৪৪ জনমাস। এটা নিয়েও প্রশ্ন করেছে কমিশন।

পরামর্শক নিয়োগ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিত কর্মকার বলেন, সদ্যসমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৩০ শতাংশ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ কার্যক্রমও একই প্রকৃতির। তারপরও প্রকল্পে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।

এলজিইডি’র আবদার ৩৬টি জিপ-পিকআপ ভ্যানের, পেল মাত্র তিনটি

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়- ফাইল ছবি

তিনি একই প্রকৃতির বিষয়ভিত্তিক পরামর্শকের সংখ্যা এবং জনমাস কমিয়ে এ খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করতে পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, ফার্মের মাধ্যমে পরামর্শক সেবা গ্রহণ না করে ব্যক্তি পরামর্শক নিয়োগ করা হলে প্রকল্পের কাজ অধিক ফলপ্রসূ হতে পারে। এ কারণে পরামর্শক ফার্মের পরিবর্তে ব্যক্তি পরামর্শক নিয়োগ করে প্রকল্পের কাজ করা যায় কিনা তা স্থানীয় সরকার বিভাগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সভাপতির এ প্রস্তাবে সংশ্লিষ্টরা একমত পোষণ করেন।

প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ২ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৫১৬ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ ২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা এবং অনুদান ৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। জুলাই ২০২২ হতে জুন ২০২৯ পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে জানানো হয় যে, প্রকল্পে ১০টি জেলার ২২টি পৌরসভায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সকল পৌরসভায় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রশাসকের সঙ্গে এলজিইডি’র মাধ্যমে সমন্বয়পূর্বক সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন।

আরও পড়ুন: কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যেই উপকূল বিনির্মাণে ৬২ যানবাহনের আবদার

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের পূর্ত কাজের কোনো কনসেপচুয়াল ডিজাইন দেওয়া হয়নি । এ প্রসঙ্গে এলজিইডি’র প্রতিনিধি জানান, সকল ভৌত কাজের ধারণাগত ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিপিপি’র (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে বিধায় তা ডিপিপিতে দেওয়া হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০২২ হতে জুন ২০২৯ পর্যন্ত অর্থাৎ ৭ বছর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা বিভাগ ২০২২ সালে জারিকৃত পরিপত্র অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল হবে তিন বছর।

এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিনিধি জানান যে, এডিবি’র সঙ্গে ঋণ প্রক্রিয়াকরণের সময় সর্বোচ্চ সামাজিক উপকার বিবেচনায় নিয়ে এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল বছর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ড. সাঈদ হাসান শিকদার এ প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রকল্পের মেয়াদ বেশি হলে আবর্তক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং ৭ বছরে কমপক্ষে ৩ বার রেইট শিডিউল বৃদ্ধি পাবে। ফলে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণে যতো কম সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে প্রকল্প এলাকার জনগণ ও দেশ ততো বেশি উপকৃত হবে।

এলজিইডি’র আবদার ৩৬টি জিপ-পিকআপ ভ্যানের, পেল মাত্র তিনটি

এলজিইডি ভবন- ফাইল ছবি

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন জানায়, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার সময় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন নীতিমালাকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রকল্পের মেয়াদ ৭ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর করা যেতে পারে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোট ২৫২ জন জনবল ডেপুটেশন এবং আউটসোর্সিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ বিভাগ ৬৫ জন জনবল অনুমোদন করেছে।

কমিশন আরও জানায়, প্রকল্পের আওতায় পাঁচতলা ভিত্তি বিশিষ্ট ২৩টি দোতলা সাইক্লোন শেল্টার স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী সাইক্লোন শেল্টার স্থাপনের এখতিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, এলজিইডি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করে থাকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের আওতায় কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় এলজিইডি এ কাজ বাস্তবায়ন করছে। তবে ডিপিপিতে শুধু সাইেক্লান শেল্টার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে তা সংশোধন করা হবে।

কমিশন জানায়, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ পৌরসভায় ২টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পৌরসভা দু’টিতে কখনও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হয় না। এখানে সাইক্লোন শেল্টারের পরিবর্তে এ অর্থ দিয়ে দৃশ্যমান ও প্রয়োজনীয় ভৌত নির্মাণ কাজ করা যেতে পারে।

প্রকল্পের আওতায় ৬৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ২৯৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, ৯২০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ, ১৪০ কিলোমিটার ড্রেনেজ কাজ, ২৩টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, ২২টি বস্তি উন্নয়ন, চারটি বাস টার্মিনাল ও দুটি গ্রিন স্পেস নির্মাণ করা হবে।

বরগুনার পাথরঘাটা, বেতাগী, বরিশালের বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জ, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, গৌরনদী, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি ও নলছিটি, ভোলার লালমোহন, চরফ্যাশন ও বোরহানউদ্দিন পৌরসভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এছাড়াও বাগেরহাটের বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জ, খুলনার চালনা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার কলারোয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ পৌরসভা রয়েছে প্রকল্পের আওতায়।

প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় শহরসমূহের জলবায়ু ও দুর্যোগ সহনশীলতা শক্তিশালী করা হবে। একইসঙ্গে উন্নয়ন করা হবে নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান। উপকূলীয় ১৯টি জেলার মধ্য ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ১১টি জেলাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মোট ৪৩টি পৌরসভার উন্নয়ন করা হবে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে ২২টি পৌরসভাকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

এমওএস/এসএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।