দুগ্ধ শিল্পের সংকট

খামারিদের ‘হোঁচট’ বাজারজাতকরণে

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৮:৫৬ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২২
গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিপাকে খামারিরা

ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনার দুগ্ধশিল্প। নানা চ্যালেঞ্জ উতরে প্রতি বছরই বাড়ছে দুধের উৎপাদন। কিন্তু বাজারজাতকরণ প্রতিবন্ধকতায় হোঁচট খাচ্ছেন খামারিরা। প্রান্তিক পর্যায়ে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত বা সংরক্ষণের অপর্যাপ্ত সুবিধা ও পণ্য বহুমুখীকরণের সক্ষমতা না থাকা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে খামারিদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহন সমস্যা। এসব কারণে অনেক সময় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। একই সঙ্গে সমানতালে বেড়েছে গো-খাদ্যের দাম। গো-খাদ্যের এ বাড়তি দাম এখন খামারিদের মাথাব্যথার নতুন কারণ। কারণ এমনিতেই গোচারণ ভূমির অভাব রয়েছে, নেই উন্নতমানের ঘাস। এ অবস্থায় গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি খামারিদের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

ডেইরি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন বাড়িয়ে যদি বাজারজাতকরণ নিশ্চিত না করা হয়, তবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের দুগ্ধ খামারিদের টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এতে দুগ্ধ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, ব্যাহত হতে পারে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার এ যাত্রা। একই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের লাগাম টানা না গেলে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে এ খাত।

অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদিত দুধের সঠিক ব্যবহারের জন্য সরকারের যথাযথ দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে গুঁড়া দুধ আমদানির ক্ষেত্রেও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ রয়েছে। এর মধ্যে দুগ্ধ উৎপাদন থেকে ডেইরি হাবগুলোতে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একটি সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ‘প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)’ নামের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বর্তমানে এ খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটি আশা জাগিয়েছে ডেইরি খামারিদের মনে। তারা বলেছেন, এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ডেইরি খাতকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।

এলডিডিপি প্রকল্পের অধীনে ৩ হাজার ৩৩৩টি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রুপ তৈরি করা হবে। প্রতিটিতে ২০ থেকে ৪০টি খামার থাকবে। গুণগত মান বজায় রাখতে সারাদেশে ৪০০টি দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্র করা হবে। এর মধ্যে ১৭৫টিতে দুগ্ধ শীতলীকরণ ব্যবস্থা থাকবে।

আরও পড়ুন: দুগ্ধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দূরে নয়

দুধকে বলা হয় পৃথিবীর সেরা খাবার। পুষ্টিমানের দিক থেকে দুধের জুড়ি নেই। দুধে থাকা ল্যাকটোজ মানুষের দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বাড়াতে সহায়ক। মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও মূল ভূমিকা রাখতে পারে দুধ। গরুর দুধে আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ- যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিংক, আয়োডিন ও সেলিনিয়াম। গরুর দুধের কম্পোজিশনে পানি ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ফ্যাট ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজপদার্থ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

দেশে দুধ উৎপাদন ও চাহিদার চিত্র

দেশে দুধের উৎপাদনে এখনো ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ প্রয়োজন। এর বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষ ২০৮ মিলিলিটার পাচ্ছে। দেশে এখন বছরে দুধের উৎপাদনে ঘাটতি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার টন।

মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৭ লাখ ধরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বছরে দেশে দুধের চাহিদা এক কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার টন। সেখানে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টন। যদিও প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে দেশে দুধের উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ছিল মাত্র ২২ লাখ ৮০ হাজার টন।

jagonews24

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা গেছে, দুধের উৎপাদন ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। কিন্তু এর পরের দুই বছর উৎপাদন আবার কমে যায়। ২০০৮-০৯ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২ লাখ ৯০ হাজার ও ২৩ লাখ ৭০ হাজার টন দুধ উৎপাদন হয়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে দুধের উৎপাদন যথাক্রমে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন, ৫০ লাখ ৭০ হাজার টন, ৬০ লাখ ৯২ হাজার টন ও ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টন।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ছিল ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৯২ লাখ ৮৩ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৪ লাখ ১ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৯ লাখ ২৩ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টন ও ২০২১-২২ অর্থবছরে এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়।

চ্যালেঞ্জ মাড়িয়েই এগোচ্ছেন খামারিরা

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এখন দুধের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু বিক্রয়মূল্য আগের মতোই আছে। আমরা সরকারের কাছে নীতি-সহায়তা চাচ্ছি। অবাস্তব কিছু আমরা চাই না। গরুপ্রতি উৎপাদন যদি বেড়ে যায়, তাহলে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। যে গরু থেকে আমি ১০ কেজি দুধ পাই, সেখানে যদি ২০ কেজি দুধের কোনো গরুর জাত আমাকে দেওয়া হয় তাহলে উৎপাদন ব্যয় কমবে। এছাড়া আমদানিনির্ভর গো-খাদ্যের শুল্কও কমাতে পারে সরকার।

মাঠ পর্যায়ের দুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার বলে জানান তিনি। সেক্ষেত্রে প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে বলে তার অভিমত।

আরও পড়ুন: পাঁচ বছরের মধ্যে দুধের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির আশা

গরুর গোবর থেকে সার তৈরি করে যদি খামারির আয়ের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে উৎপাদন খরচ কমবে বলে মনে করেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, গরুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সরকার এগিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।

দুধ বিক্রিরও পিক ও অফপিক সময় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার দুধ বিক্রি করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু রবি, সোম ও মঙ্গলবার দুধ বিক্রি করতে বেগ পেতে হয়। এই তিনদিনে (রবি, সোম ও মঙ্গলবার) দুধ যদি সরকার সংগ্রহ করে পাউডার করে সংরক্ষণ করে পরে আপদকালে বা শীতকালে বাজারে ছাড়ে, তাহলে বাজারে দামের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকবে, খামারিরাও ন্যায্যমূল্য পাবেন।

ডেইরি শিল্পের স্বার্থে গুঁড়া দুধের আমদানি ক্রমান্বয়ে কমানো দরকার বলেও মনে করেন ইমরান হোসেন।

দেশে দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ভোলা জেলা। জাতীয়ভাবে ঘাটতি থাকলেও ভোলায় স্থানীয় চাহিদার চেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু সেখানকার খামারিরাও নানা সমস্যা মোকাবিলা করেই এগোচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

ভোলা সদরের মানিক অ্যাগ্রোর মালিক কামরুল হাসান খোকন বলেন, ভোলায় ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ ডেইরি ফার্ম রয়েছে। ভোলায় প্রচুর দুধ উৎপাদন হয়। দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভোলা শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, এখানে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হয়। তবে ভোলায় দুধ সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

jagonews24

দুধ থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, যাতে খামারিরা জানতে পারেন, দুধ থেকে কীভাবে ক্রিম তুলতে হবে, ক্রিম তোলার পর সেই দুধ দিয়ে কীভাবে মাঠা ও লাবং করতে হবে, কীভাবে পনির ও দধি তৈরি হবে- এগুলো করার জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু সেগুলো আমরা কখনো পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভোলা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন বলেন, ভোলার খামারিদের নির্ভর করতে হচ্ছে মিষ্টির দোকানের ওপর। উৎপাদন আমরা করলেও মিষ্টির দোকানগুলোর ওপর নির্ভর করার কারণে দুধের দাম নির্ধারণ করতে পারি না। কিন্তু আমাদের প্রাণী খাদ্যের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে, ওষুধের দাম বেড়েছে। আমরা দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না। দাম নির্ধারণের বিষয়টি মিষ্টির দোকানিদের হাতে। যেহেতু দুধ বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। আমরা যদি দুধ থেকে বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত দ্রব্য) তৈরি করতে পারতাম, তাহলে আমাদের তাদের ওপর নির্ভর করতে হতো না।

তিনি বলেন, এছাড়া ভোলার চারপাশ পানিবেষ্টিত। মাঝে মধ্যেই দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসছে। ঝড়-বন্যা হলে মিষ্টির দোকানগুলো আর দুধ নেয় না, কারণ তাদেরও তখন বিক্রি কমে যায়। ওই সময় আমাদের ২০-৩০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হয়, অনেক সময় ফেলেও দিতে হয়।

‘ভোলা সদরের লাহারি বাজারের মাঝের চরে মিল্কভিটার একটি সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। তবে সেটি উপযুক্ত জরিপের ভিত্তিতি স্থাপন করা হয়নি। এটি অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন একটি স্থান। এটি দিয়ে খামারিদের খুব বেশি উপকার হচ্ছে না। এটি এমন স্থানে স্থাপন করা প্রয়োজন ছিল যেখান খামারিরা সহজে গিয়ে দুধ দিতে পারেন। তাই আমরা মিল্কভিটা দিয়ে লাভবান হতে পারছি না।’

এই অবস্থায় এলডিডিপি প্রকল্প খামারিদের জন্য খুবই উপকারী হবে। এটা দ্রুত হওয়া উচিত বলেও মনে করেন ভোলার এই খামারি।

দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী জেলা পাবনা। পাবনায় বছরে সাড়ে ৪ লাখ টন দুধ উৎপাদন হয়। পাবনায় ডেইরি খামারি রয়েছেন ১০ হাজারের মতো।

আরও পড়ুন: এক দশকে দুগ্ধ উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি

পাবনার ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের বুড়ামপুর গ্রামের তন্ময় ডেইরি ফার্মের মালিক আমিরুল ইসলাম। এ খামারে বর্তমানে ১০০টির মতো গরু আছে। প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৬০০ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে এ খামারে। আমিরুল বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের পাবনা জেলা শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন।

আমিরুল জাগো নিউজকে বলেন, ১৪ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে খামার শুরু করি। এরপর ধীরে ধীরে তা বেড়েছে। একসময় বাছুরসহ ১৪৫টি গরু ছিল। বাছুর বিক্রি করার পর এখন ১০০টির মতো আছে। আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি ভোক্তাদের নিয়েও ভাবতে হবে। এখন প্রাণিখাদ্যের দামটা একটু বেশি। এটা সরকারের দেখা উচিত।

তিনি বলেন, আমরা যদি গোবরকে একটি পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম, সেখান থেকে লাভবান হতাম। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে জোর দিতে পারে সরকার। এটি পরিবেশবান্ধবও। আমরা চাই সরকার গোবরকে বাজারজাত করার মতো প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ আমাদের দিক। একই সঙ্গে সরকার এ বিষয়ে প্রচার-প্রচারণাও চালাতে পারে।

‘এক সময় বেশিরভাগ দুধই মিল্কভিটায় বিক্রি করতাম। কিন্তু মিল্কভিটার চাহিদার চেয়ে আমাদের উৎপাদন বেশি হয়ে যায়, তখন দুধ থেকে যায়। তখন আমাদের বাইরে বিক্রি করতে হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুধ বিক্রির বিকল্প নেই। এটা খামারিদের জন্য নিরাপদ। এরপরও নানা বিবেচনায় আমরা স্থানীয় ভোক্তাদের এখন গুরুত্ব দিচ্ছি।’

আমিরুল ইসলাম বলেন, এখন দেশের গরু দিয়েই কোরবানি হয়, বিদেশ থেকে কোনো গরু আসে না। সেটা পারলে আমরা দুধেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো। তবে এখন যেটুকু উৎপাদন করি সেটুকু নিয়েও যদি বিপদে পড়তে হয়, তাহলে কিন্তু কেউই উৎপাদন বাড়ানোর কথা চিন্তা করবে না। ফলে দুধ বিক্রি বা প্রক্রিয়াজাতের বিষয়ে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, করোনার সময় আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিপদে পড়তে হয়। ন্যায্যমূল্য পাই না। গুঁড়া দুধ আমদানির ক্ষেত্রেও সরকারকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। অবাধে গুঁড়া দুধ আসছে। এর ফলে দেশের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

পাবনা সদরের মোহাম্মদ আলী ডেইরি ফার্মের মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের খামারে ৩০টি গরু আছে। প্রতিদিন ২০০ লিটারের মতো দুধ হয়। দুধ অনেক সময় ২০-৩০ টাকায়ও বিক্রি করতে হয়। তখন খরচও ওঠে না। মিষ্টির দোকানে দুধ দেই, প্রতি মণ ২ হাজার টাকা দরে। প্রতি লিটারের দাম পড়ে ৫০ টাকা। এ দাম আর বাড়ছেই না। যখন অনেক কম দামে ভুসি কিনে গরুকে খাইয়েছি তখন দুধের যে দাম পেতাম, এখনো তাই।

ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে বিপুলসংখ্যক ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। শুধু বিরুলিয়াতেই ২০০টির মতো ফার্ম রয়েছে। বছর দশেক আগে সেখানে ১০/১২টির মতো ফার্ম ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাভার ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন যুগ্ম-সম্পাদক সাইদুল কুদ্দুস রনির রয়েছে ‘গ্রিন ফার্ম হাউস’ নামে একটি খামার। সার্বিক বিষয়ে রনি বলেন, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর আমাদের দেশে এ খাতে প্রচুর নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সরকার যদি একটু সহায়তা করে তাহলে এ খাতকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

তিনি বলেন, দেশে দুধ উৎপাদনে ২০ শতাংশের মতো ঘাটতি রয়েছে। তবে এখন আমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ গো-খাদ্যের দাম।

jagonews24

আরও পড়ুন: দুধের উৎপাদন বাড়াতে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান

একটি ভালো জাতের গাভি থেকে দিনে দুবার দুধ পাওয়া যায় জানিয়ে এ খামারি বলেন, সকালে ৭০ শতাংশ ও বিকেলে ৩০ শতাংশ দুধ পাওয়া যায়। সকালে দুধের দাম কম থাকে। কারণ দুধ বেশি আসে, আমাদের সংরক্ষণ করার ব্যবস্থাও নেই। এ কারণে সকালে দুধের দাম কম পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়াও পরিবহন সমস্যার কারণে প্রতিদিন প্রচুর দুধ নষ্ট হচ্ছে।

সাইদুল কুদ্দুস রনি আরও বলেন, এলডিডিপি প্রকল্প খামারিদের জন্য খুবই ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। যদি প্রকল্পের ৫০ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়, তাহলেও আমরা উপকৃত হবো।

সমস্যা ও সমাধান নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা ভাবছেন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল রানা সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ডেইরি শিল্পের জন্য ছোট ছোট পরিসরে প্রসেসিং প্ল্যান্ট করা উচিত। সেখানে ভ্যালু অ্যাডিশন হবে। আমরা তরল দুধ বিক্রি করবো, একই সঙ্গে দই, পনির বিক্রি করবো। একজন খামারি ভ্যালু অ্যাডিশনে থাকলে তার লাভটা বেশি হবে, তিনি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবেন। তাই ভ্যালু অ্যাডিশনটা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমাদের খামারিরা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভাবেন না, এ বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এতে উন্নতমানের পণ্য পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে সরকার হয়তো বলে দিতে পারে, খামারের রেজিস্ট্রেশন নিতে হলে ন্যূনতম এ ট্রেনিংটা নিতে হবে।

চরাঞ্চলে প্রচুর মহিষের দুধ পাওয়া যায় জানিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল রানা সিদ্দিকী বলেন, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত কারণে সেগুলো আমরা মূল ধারায় আনতে পারছি না। ওসব স্থানে ছোট ছোট প্রক্রিয়াজাত প্ল্যান্ট করা হলে কিন্তু সেটি অনেক সহজ হয়ে যেতো। সেখানে মহিষের দুধ ইউএইচটি (উচ্চ তাপমাত্রায় জীবণুমুক্ত করা) করে আমরা সহজে মূল বাজারে নিয়ে আসতে পারি।

তিনি আরও বলেন, বাজারে অনেক নিম্নমানের গুঁড়া দুধ পাওয়া যায়। যেগুলো বিদেশ থেকে আসে। এটিও ডেইরি শিল্পর একটি সমস্যা। বিদেশ থেকে সরকারকে গুঁড়া দুধ আনার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে দেশের ডেইরি শিল্পের উন্নয়ন টেকসই হবে।

‘ভারত দুধ উৎপাদনে এক নম্বর, তারা কীভাবে এ অবস্থানে এসেছে? ভারতে এমনও আছে, যেসব অঞ্চল থেকে দুধ আসে, সেখানে সকালে গোয়ালাদের জন্য ট্রেন চলে। এগুলোও আমাদের দেখার বিষয়।’

প্রাণিখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ডেইরি খাতের অন্যতম বড় সমস্যা জানিয়ে এ শিক্ষক বলেন, এক্ষেত্রে সরকার প্রাণিখাদ্য আমদানিতে ভর্তুকি দিতে পারে। এছাড়া ডেইরি শিল্প মালিকরা গবেষণা ও উন্নয়ন (আর অ্যান্ড ডি) উইং করতে পারেন। তারা কী চান, সমস্যাগুলো কীভাবে উতরানো যায়, কীভাবে মান উন্নয়ন করা যায়? এক্ষেত্রে ওই উইং গবেষণা করে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে উপায় জানিয়ে দেবে। বিদেশে এটা আছে।

আরও পড়ুন: মোট চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ দুধ সরবরাহ করছেন দেশি উদ্যোক্তারা

তিনি বলেন, ডেইরি শিল্পর উন্নয়নে সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এলডিডিপি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতকেও আন্তরিক হতে হবে। তবে সবাইকেই কঠোর তদারকির মধ্যে আসতে হবে। সবার জবাবদিহি থাকতে হবে। তাহলেই এ খাতে আমাদের অর্জন টেকসই হবে।

যা বলছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক জাগো নিউজকে বলেন, দুগ্ধশিল্প একটা লাইভ ইন্ডাস্ট্রি। এর মানে হলো জীবন্ত একটা বিষয়কে লালন-পালন করে সেটা থেকে উৎপাদন নিয়ে সাপ্লাই চেইনে যেতে হয়। এটাকে বলে ভালনারেবল বিজনেস। এখানে ঝুঁকির বিষয়টি অনেক অনেক বেশি। দেশে ভালো ঘাস নেই, জায়গা নেই। এসব নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে রাতারাতি উন্নত দেশের মতো ডেইরি শিল্প গড়ে তুলবেন, সেটা এত সহজ নয়। ধীরে ধীরে অনেক চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে হয়। সেদিকে আমাদের খামারিরা যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, জাতের একটি বিষয় আছে। অনুৎপাদনশীল থেকে উৎপাদনশীল জাতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেখানেও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে সার্বিক অবস্থার প্রস্তুতি লাগবে।

মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, এত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা একটা ভালো জায়গায় আসছি। আমাদের শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী খামারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তারা টিকে আছেন।

jagonews24

তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার আমাদের বিভাগ থেকে তা করা হয়। মান্ধাতার আমলের মতো খড় বা ভুসির ওপর নির্ভর করে গরু পালন করবেন, এটা হবে না। ঘাস চাষ করতে হবে, সাইলেজ করতে হবে, টিএমআরে যেতে হবে। এগুলোতে যেতে আমরা খামারিদের উৎসাহিত করছি। অনেকেই এখন নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলছেন।

‘এভাবে যদি আমরা চলতে থাকি, সময় একটু বেশি নিলেও একটা জায়গায় আমরা ইনশাআল্লাহ পৌঁছে যাবো।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক আরও বলেন, অন্যদিকে এলডিডিপি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেটি আরও বহুমুখীভাবে কাজ করছে। বিজনেস মডিউলিং, দুধের ভ্যারাইটি কী হবে, দুধ থেকে পনিরসহ নানা পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে এ প্রকল্প।

দুধ সংগ্রহ ও শীতলকরণ কেন্দ্র হবে এ প্রকল্পের আওতায়। তখন হয়তো সমস্যাগুলো আরও কমে আসবে, যোগ করেন রেয়াজুল হক।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আল মামুন হোসেন মণ্ডল বলেন, দুধ বাজারজাত করা ও গো-খাদ্যের দাম এখন খামারিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা খামারিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যাতে তারা ঘাস বেশি করে উৎপাদন করেন। এতে দানাদার খাবার কম দিলেও হবে। এক্ষেত্রে খামারিদের খরচ কিছু কমবে। এলডিডিপি প্রকল্পের অধীনে খামারিদের গ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, খামারিরা অনেক সময় দুধ বিক্রি নিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। তাই তারা যাতে গ্রুপভিত্তিতে নিজেরা চিলিং প্ল্যান্ট করতে পারেন, প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন- সেজন্য প্রকল্পের অধীনে কাজ হচ্ছে। দুধ থেকে ক্রিম আলাদা করার জন্য আমরা মেশিন সরবরাহ করছি। এলডিডিপি প্রকল্পের অধীনে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

ভোলা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভোলায় (জেলাভিত্তিক) দুধের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুধ উৎপাদনের লক্ষ্য এক লাখ ৫৪ হাজার টন। এর মধ্যে ২০ হাজার টন মহিষের দুধ। গত অর্থবছরে দুধের মোট উৎপাদন ছিল এক লাখ ২৯ হাজার টন।

তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে ৩০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি আমরা। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে মাথাপিছু দৈনিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৫৭ মিলিলিটার। বর্তমানে আমাদের উৎপাদন ১৭৫ মিলিলিটার।

ইন্দ্রজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, ভোলার ব্র্যান্ডিং হলো দধি। এই দধি লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে চলে যায়। এখানে মিষ্টিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে মহিষের দধিই জনপ্রিয়, কারণ মহিষের দুধে ফ্যাট বেশি। দুই লিটার গরুর দুধের সমপরিমাণ ধরা হয় এক লিটার মহিষের দুধ। প্রতি লিটার মহিষের দুধের খুচরা দাম এখন ১২০ টাকা।

তিনি বলেন, এখানে মিল্কভিটার ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার শীতলকরণ প্ল্যান্ট আছে। বোরহানউদ্দিন ও লালমোহনে আরও দুটি প্ল্যান্ট স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।

ইন্দ্রজিৎ কুমার মণ্ডল আরও বলেন, তবে প্রকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারি বা এমন কিছু হলে দুধ নিয়ে খামারিদের বিপাকে পড়তে হয়। করোনার সময় আমাদের ২৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করতে হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে এখানে আমরা মিল্কভিটাকে এনেছি। এছাড়া আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।

আরও পড়ুন: ‘দুগ্ধ-শিল্প ধ্বংস করতে গুঁড়া দুধ আমদানি’

কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতিদিন একজন মানুষের দুধের চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার, আমাদের জেলায় মাথাপিছু উৎপাদন ২২০ মিলিমিটার। এখন কুষ্টিয়ায় বছরে উৎপাদন এক লাখ টনের মতো।

দুধের দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের খামারিরা পিছিয়ে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সহায়তা দেবো। আমাদেরও প্রচেষ্টা আছে।

আশা জাগাচ্ছে যে প্রকল্প

প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্প প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ২০১৯ সালে নেওয়া পাঁচ বছরের প্রকল্পটি আগামী বছর শেষ হবে। প্রকল্প ব্যয়ের ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এ প্রকল্পের অনেকটা অংশ জুড়ে থাকছে ডেইরি খাত। এর আওতায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন গ্রামে ৪০০টি দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্র করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা হবে। একটি সেন্টার তৈরিতে যে অর্থ প্রয়োজন হবে তার সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা করা হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই এসব সেন্টার গড়ে তোলা হবে। যেসব স্থানে যাতায়াত ব্যবস্থা কিছুটা খারাপ, সেদিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে।

এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ১৭৫টি শীতলকরণ কেন্দ্র করা হবে। প্রথমে কৃষক যে দুধ বিক্রি করবেন সেগুলো ভালো কনটেইনারে কালেকশন সেন্টারে যাবে। সেই কালেকশন সেন্টারের মালিক হবেন ব্যবসায়ীরা। এরপর কালেকশন সেন্টারের দুধ আঞ্চলিক হাবে যাবে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে প্রসেসিং প্ল্যান্টে। এরপর সব প্রক্রিয়া শেষে ভোক্তার কাছে চলে যাবে।

jagonews24

ডেইরি ফার্ম মালিকসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ডেইরি খাতে বড় ধরনের একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। শৃঙ্খলও হবে এ খাতটি।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান প্রযুক্তিগত সমন্বয়কারী মো. গোলাম রাব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে তিন স্তরে সরকার সহায়তা দিচ্ছে। প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদন পর্যায়ে খামারিদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষিত করা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে। এতে উপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে। খাদ্যটাকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদন করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা হবে।

‘এছাড়া খামারিদের বাজারে প্রবেশ করতে দেওয়া, তাদের মার্কেট কানেটিভিটিটা এখানে বাড়ানো হবে। যারা মার্কেট প্লেয়ার তারা কুলিং সিস্টেমটা এনশিওর (নিশ্চিত) করবে। একই সঙ্গে তারা পণ্য বহুমুখীকরণের কাজ করবে। এতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং ভোক্তার সন্তুষ্টি বাড়বে। কারণ যার যেটা পছন্দ সেটা কিনতে পারবে।’ যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: দুগ্ধ খামারিদের মুখের হাসি কেড়ে নিচ্ছে গো-খাদ্য

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ এখন মাংস ও ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুধের স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। চাহিদার আলোকে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল ও উন্নত জাতের গবাদিপশু পালনে খামারিদের উৎসাহিত করছে।

তিনি বলেন, উন্নত জাতের সিমেন সরবরাহ, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে খামারিদের। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মহিষের জাত উন্নয়নে সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব উদ্যোগের ফলে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের অধিক। কিন্তু উৎপাদিত দুধের সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ না হওয়ায় অনেক সময় খামারিরা দুধের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া দুধের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়টিও ততটা গুরুত্ব পায়নি। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে দুধের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সহজীকরণ, বাজারের সঙ্গে খামারিদের সরাসরি সংযুক্তকরণসহ এর বহুমুখী ব্যবহারে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

মন্ত্রী আরও বলেন, দুধ থেকে কীভাবে বিভিন্ন রকম দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করা যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত দুধের সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দুধ সংরক্ষণের জন্য খামারিদের কুলিং সিস্টেম প্রদান করা হচ্ছে। সারাদেশে খামারিদের সংগঠিত করে প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে। স্থাপন করা হচ্ছে ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার। এ সেন্টারে খামারিরা ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারবেন। এছাড়াও তৈরি করা হচ্ছে ডেইরি হাব। এ ডেইরি হাব থেকে দুধ প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য আকারে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাবে।

আইএইচআর/কেএসআর/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।