রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ‘ছোট কেনাকাটায় বড় অনিয়ম’

ইয়াসির আরাফাত রিপন
ইয়াসির আরাফাত রিপন ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত: ০৮:২০ এএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি: জাগো নিউজ

রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের জেনারেটর, ফার্নিচার, ডেস্কটপ কম্পিউটার-ল্যাপটপ ক্রয়সহ নানা বিষয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কোনো কিছু না কিনেও তুলে নেওয়া হয়েছে বিল। খোদ রিহ্যাবের এক পরিচালকের বিরুদ্ধেই আনা হয়েছে এমন অভিযোগ। আবাসন ব্যবসায়ীদের বড় এ সংগঠনটির ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গভর্নিং বডি ও রিহ্যাব অর্থ ও ক্রয় সংক্রান্ত উপ-কমিটি এ সংক্রান্ত অনিয়মের সত্যতাও পেয়েছে। পরে এসব অনিয়মের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি।

জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রিহ্যাব পরিচালনা পর্ষদের সভায় রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (আরটিআই) চেয়ারম্যানের প্রস্তাবনায় ও সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। এই কমিটির কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এবং দৈনন্দিন কাজের সুবিধার্থে দুটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। সেগুলো হলো- ‘অর্থ ও ক্রয় সংক্রান্ত উপ-কমিটি’ ও ‘জব রিপ্লেসমেন্ট ও নিয়োগ সংক্রান্ত উপ-কমিটি’। পরে স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় আরটিআই চেয়ারম্যানের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কমিটি দুটিকে আরটিআই’র আয়-ব্যয় ও সম্পাদিত কার্যক্রম যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইআইপি) ও রিহ্যাবের যৌথ এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। এরপর প্রকল্পের অধীনে আসবাবপত্র, জেনারেটর, কর্মচারীদের জন্য ল্যাপটপ ও ডেস্কটপসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয়, যা আরটিআই বা রিহ্যাবের সম্পদ বলে বিবেচিত।

আরও পড়ুন: বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ চায় রিহ্যাব

তবে এসব বিষয়ে অভিযোগ আসায় প্রকল্পের অর্থ ও ক্রয় সংক্রান্ত উপ-কমিটি, আরটিআই ও রিহ্যাব অ্যাকাউন্টস বিভাগ ব্যয়ের হিসাব যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়। তারা প্রকল্পের জন্য কেনা বিভিন্ন মালামালের তথ্য-উপাত্ত বিল, পেমেন্ট ভাউচার নিরীক্ষা করে। তবে নিরীক্ষাকালে এসব মালামালের প্রকৃত কোনো বিল বা ভাউচার পায়নি উপ-কমিটি। এ অবস্থায় উপ-কমিটি রিহ্যাবকে বিভিন্ন অনিয়মের কথা লিখিত আকারে জানায়। উপ-কমিটি যেসব পণ্যে অনিয়ম পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- জেনারেটর ক্রয় ও সার্ভিস সংক্রান্ত, ফার্নিচার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ ক্রয়, কিশোরগঞ্জের আইয়ুব-হেনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বেতন-ভাতাসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে।

রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের কেনাকাটা যাচাই-বাছাই করতে প্রথমে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা তদন্ত শেষে বিভিন্ন অনিয়ম পান। এরই মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন রিহ্যাবে জমা দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং এ বিষয়ে করণীয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এখন প্রক্রিয়াধীন। এসব অভিযোগের তীর ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আল-আমিনের বিরুদ্ধে। তিনি রিহ্যাবের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিভিন্ন কেনাকাটায় এ অনিয়ম করেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এরইমধ্যে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তদন্তে উঠে এসেছে, দরপত্র ছাড়াই অতিরিক্ত দামে কেনাকাটা করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য রাজধানীর ধোলাইখাল থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে নিম্নমানের একটি জেনারেটর তৈরি করা হয়। অথচ ওই জেনারেটর বাবদ বিল করা হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য কেনাকাটায়ও বিস্তর দুর্নীতির তথ্য মেলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেনাকাটায় দরপত্রে কারসাজি আবার কোথাও দরপত্র ছাড়াই হয় কেনাকাটা। এ সংক্রান্ত কেনাকাটার বেশ কিছু কাগজপত্র জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

আরও পড়ুন: রিহ্যাব সভাপতির বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা অর্থ তছরুপের অভিযোগ

উপ-কমিটির তদন্তে বলা হয়, আরটিআই’র জন্য যুক্তরাজ্যের একটি ব্র্যান্ড দেখিয়ে ৯ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকায় একটি জেনারেটর কেনা হয়। যুক্তরাজ্যের একটি দামি ব্র্যান্ডের কথা বলা হলেও এর যন্ত্রাংশ চীনের এবং প্রস্তুত করা হয়েছে লোকাল মার্কেট থেকে। ওই জেনারেটরের মূল দাম ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে জেনারেটরটি চীনের নিম্ন মানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করায় প্রকৃত খরচ হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে জেনারেটরের মূল দাম বিবেচনা করলেও এ খাতে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৭০০ টাকার অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। তবে জেনারেটরের ক্রয়মূল্য ধরলে এ ক্ষতি আরও বেশি। এমনকি কোনো কিছু না কিনেও তুলে নেওয়া হয় বিল। ২০১৯ সালে রিহ্যাবের নিজস্ব অর্থে এই প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনা হয়। অথচ পরে ওই আসবাবপত্র বাবদ এসইআইপির তহবিল থেকে টাকা নেয়। অর্থাৎ এ খাতে কোনো কেনাকাটা না করেই অর্থ উত্তোলন করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট রিহ্যাব অ্যাকাউন্টসে ৩ লাখ ৬ হাজার টাকা জমা করা হয়।

প্রকল্পের জন্য কেনা হয় এইচপি প্রোডেস্ক-ফোরজি মডেলের ১৬টি ডেস্কটপ কম্পিউটার। এসব কম্পিউটারের প্রতিটির বাজারমূল্য ৪১ হাজার টাকা। অথচ প্রতিটি কম্পিউটার বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি কম্পিউটারে ২৯ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে শুধুমাত্র ডেস্কটপ কম্পিউটার ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকার অনিয়ম পায় উপ-কমিটি। একই সঙ্গে এইচপি প্রোবুক-কোর আই সেভেন ল্যাপটপ কেনা হয় দুটি। যার প্রতিটির বাজারমূল্য ছিল ৬৮ হাজার টাকা। অথচ এসব ল্যাপটপ কেনা বাবদ প্রতিটিতে খরচ দেখানো হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা করে। এমনকি ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেও অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। কিশোরগঞ্জের আইয়ুব-হেনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের ৬ মাসের বেতন-ভাতা কেটে নেওয়া ও বন্ধ করার ক্ষেত্রেও অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। রিহ্যাব পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মেলে।

অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আল-আমিনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি রিহ্যাবের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে যখন কথা বলেছি, তখনই একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে এমনটা করেছে। আমার জীবনে কোনো আর্থিক অনিয়ম নেই। এসব প্রকল্পে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। এমনকি এসব বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে কি না সেটাও জানি না। তবে নিউজ হলে আমি মানহানির মামলা করবো।

আরও পড়ুন: বাজেট পুনর্বিবেচনা না করলে ক্ষতির মুখে পড়বে নির্মাণশিল্প

ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছি। তাই ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে সময় দিতে পারছিলাম না। এসব কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি।

এসব নিয়ে কথা হয় রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (অর্থ) প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল রানার সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, রিহ্যাব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গঠিত কমিটি তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। পরে প্রকৌশলী আল-আমিনকে ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয় রিহ্যাব পরিচালনা পর্ষদ।

তিনি বলেন, প্রকৌশলী আল-আমিন ট্রেনিং সেন্টারের জন্য এটি জেনারেটর কেনেন, যাতে ইউকের (যুক্তরাজ্যের) ওয়েল অ্যান্ড পাওয়ার কোম্পানির লোগো ছিল। জেনারেটরটি তৎকালীন বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে কেনা হয়। তবে প্রথমে দামের গরমিল পান রিহ্যাব ট্রেনিং সেন্টারের কয়েকজন। দাম যাচাই করতে তারা ওয়েল অ্যান্ড পাওয়ার কোম্পানির ওয়েবসাইট সার্চ দিয়ে দেখেন ওই নামের যে জেনারেটর দেওয়া হয়েছে তা প্রতিষ্ঠানটির নয়।

সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলে প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এক্সপার্ট এনে দেখানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা জানান, এটি ওয়েল অ্যান্ড পাওয়ার কোম্পানির জেনারেটর নয়। এটি নকল এবং রাজধানীর ধোলাইখালের পণ্য, চীনের যন্ত্রাংশ সংযোজন করে যা তৈরি করা হয়েছে। এক্সপার্টরা জানান, এই জেনারেটরের দাম এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ জেনারেটর কেনা বাবদ সাড়ে ৯ লাখেরও বেশি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এখানে বড় ধরনের অনিয়ম পাওয়া যায়। আবার কম্পিউটার কেনার সময় তিনি দর-দাম ঠিক হওয়ার আগেই তা সরবরাহ করেন। এখানেও মেলে বড় অঙ্কের অনিয়মের তথ্য। কিশোরগঞ্জের আইয়ুব-হেনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়েও অনিয়ম করেছেন তিনি, যোগ করেন রিহ্যাবের সহ-সভাপতি।

ইএআর/কেএসআর/এমএস

প্রকল্পের জন্য রাজধানীর ধোলাইখাল থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে নিম্নমানের একটি জেনারেটর তৈরি করা হয়। অথচ ওই জেনারেটর বাবদ বিল করা হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টাকা।

২০১৯ সালে রিহ্যাবের নিজস্ব অর্থে এ প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনা হয়। অথচ পরে ওই আসবাবপত্র বাবদ এসইআইপির তহবিল থেকে টাকা নেয়। অর্থাৎ এ খাতে কোনো কেনাকাটা না করেই অর্থ হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযোগের তীর ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. আল-আমিনের বিরুদ্ধে। তিনি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিভিন্ন কেনাকাটায় এ অনিয়ম করেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এরই মধ্যে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।