বাড়তি করের প্রভাবে অন্য পণ্যের দামও বাড়বে

সবজির ভরা মৌসুমেও চলতি বছরের ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। টানা পৌনে তিন বছর ভোক্তারা চড়া মূল্যস্ফীতিতে রীতিমতো পিষ্ট। এর মধ্যে নতুন করে পোশাক, ফল, বিস্কুটসহ, শতাধিক পণ্যে আরোপ হয়েছে বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক। এতে আরেক দফা সব পণ্যের দাম বাড়লে আরও নাজেহাল হবে সাধারণ মানুষের অবস্থা। ব্যবসায় দেখা দেবে মন্দা।
সার্বিক বিবেচনায় ট্যাক্স না বাড়িয়ে পুনর্বিবেচনার দাবি করেন বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এই নির্বাহী পরিচালক জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ দাবি জানান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মফিজুল সাদিক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।
সামনে রমজান মাসে কিন্তু আরও বাড়বে পণ্যের দাম। যে পণ্যের ওপরে করহার বাড়ানো হয়েছে শুধু সেই পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ থাকবে না। অন্য পণ্যের দামও বাড়বে
জাগো নিউজ: মূল্যস্ফীতি বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি। অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছে। এ মুহূর্তে বর্ধিত করবৈষম্য আরও বাড়াবে কি?
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: এমন সময় কর বাড়ানো হলো যখন আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির রেজিমে আছি। আমাদের বাজারব্যবস্থাও ঘোলাটে। কখন কোনটার দাম বাড়ে ঠিক নেই। কোনো কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়ছে কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। বর্তমানে বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এক্ষেত্রে যাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে তাদের হাতে বা কিছু স্বার্থবাজের দখলে চলে গেছে, যারা নিজের স্বার্থে এই বাজারটা ব্যবহার করে।
যখন এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়লো তখন দেখা যাবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়ে গেছে। কাজেই আমার ধারণা আগামীতে পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। সামনে রমজান মাসে কিন্তু আরও বাড়বে পণ্যের দাম। যে পণ্যের ওপরে করহার বাড়ানো হয়েছে শুধু সেই পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ থাকবে না। অন্য পণ্যের দামও বাড়বে।
সরকার এই পথে না গিয়ে শর্টকাট বা সোজাপথে কর আদায় করছে এতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। সরকার যদি কর আদায়কারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতো তাহলে টেকসই একটা ব্যবস্থা হতো কর আদায়ে
এমন একটা সময়ে দাম বাড়ানো হলো যখন খুব একটা সুফল আসবে বলে আমার মনে হয় না। মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন আয়, দরিদ্র এমনকি মধ্যবিত্তেরও কিন্তু নাভিশ্বাস অবস্থা। এমন একটা পরিস্থিতিতে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে হয়। সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে।
জাগো নিউজ: সরকার অর্থ সংকট অন্যভাবে মেটাতে পারতো কি?
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সোর্স থেকে রাজস্ব আদায় করে। করহার না বাড়িয়ে কর ইফিসিয়েন্সি বাড়ালে মঙ্গল হতো। ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করলেও রাজস্ব আয় বাড়তো। ফাঁকফোকর বলতে দুর্নীতি, রাজস্ব আদায়কারী সংস্থার অদক্ষতা ছাড়াও অসংখ্য বিষয় আছে। আমাদের দেশে কর ও ট্যাক্স জিডিপি যা আছে তা পৃথিবীর সর্বনিম্ন দেশগুলোর মধ্যে একটা। নেপালেও কিন্তু কর জিডিপি আমাদের চেয়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি। কাজেই ট্যাক্স বাড়ানোর অনেক সক্ষমতা আছে। আমাদের ট্যাক্স সিস্টেম কিন্তু জটিল। আয়করের কথা যদি বলেন মানুষ কিন্তু আয়কর দিতে ভয় পায়। অনেকে আয়কর দিতে গিয়ে সমস্যা পড়ে। কাজেই অনেকে এর ধারে কাছে যেতে চায় না। আমাদের সিস্টেমের অদক্ষতা আছে।
- আরও পড়ুন
- ওষুধ-পোশাকসহ নিত্যপণ্যের ভ্যাট রিভিউ হচ্ছে: অর্থ উপদেষ্টা
- বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার না হলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না
- ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় বড় আকারে ধাক্কা খাচ্ছে শিল্পখাত
- যারা ভ্যাট বসাচ্ছেন তারা পণ্যের কস্ট অ্যানালাইসিস করেননি
জাগো নিউজ: করের রেট না বাড়িয়ে নেট বাড়ানো যেত কি?
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: আয়করের ক্ষেত্রে দেখেন কত শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। টিন কত শতাংশ মানুষের আছে। খুবই সামান্য মানুষের টিন আছে। একটা ক্ষুদ্র শতাংশ মানুষ কিন্তু ট্যাক্স দিচ্ছে। কাজেই নেট বাড়ানো যায়। অনেকে ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিট করতে চায় না। কারণ অনেকে মনে করেন ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিট করলে ঝামেলায় পড়তে হবে। কাজেই লোকে বাধ্য না হলে ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিট করে না। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেশি, কারণ ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়া যায়।
১০০টি পণ্যের মূল্য বাড়বে সঙ্গে সঙ্গে অন্য পণ্যেরও দাম বাড়বে। মূল্য বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা চলে যাবে ফলে চাহিদা কমবে। মানুষের চাহিদা কমলে উৎপাদনও কমবে। ফলে উৎপাদক বা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে
দুর্নীতি কর ব্যবস্থার রন্ধে রন্ধে এমনভাবে গ্রোথিত হয়ে গেছে সেই দুর্নীতি থেকে বের হওয়া কঠিন। তাই সরকার এই পথে না গিয়ে শর্টকাট বা সোজাপথে কর আদায় করছে এতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। সরকার যদি কর আদায়কারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতো তাহলে টেকসই একটা ব্যবস্থা হতো কর আদায়ে।
জাগো নিউজ: বর্ধিত ভ্যাট-ট্যাক্স ব্যবসার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? এটা কী প্রত্যাহার করা উচিত বলে মনে করেন?
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে শুধু উৎপাদন করলে হবে না, এগুলো বেচা-বিক্রিও করতে হবে। বাজারে চাহিদা যদি না বাড়ে তাহলে উৎপাদনও সাসটেইনেবল হবে না। চাহিদা যত বেশি হবে উৎপাদন তত বেশি হবে এবং প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। বেশির ভাগ লোকের হাতে টাকা নেই। সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে মূল্যস্ফীতি যদি বাড়ে তাহলে ক্রয়ক্ষমতা কমবে।
১০০টি পণ্যের মূল্য বাড়বে সঙ্গে সঙ্গে অন্য পণ্যেরও দাম বাড়বে। মূল্য বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা চলে যাবে ফলে চাহিদা কমবে। মানুষের চাহিদা কমলে উৎপাদনও কমবে। ফলে উৎপাদক বা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই বাজারে চাহিদা কমে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সরকারকে দেখতে হবে ভ্যাট-ট্যাক্স যুক্তিযুক্ত করা যায় কি না। ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে পুনর্বিবেচনা করা দরকার। এভাবে কোনো পক্ষই সফল হবে না। ভোক্তা আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। সরকার যে স্বপ্ন দেখছে সেটাও দুঃস্বপ্ন থেকে যাবে। মাঝখান থেকে আমাদের দেশটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের টার্গেট পূরণ হবে না।
এমওএস/এএসএ/জিকেএস