মেলায় পাইরেটেড-আইইএলটিএসের বই, শোকজে দায় সারছে টাস্কফোর্স

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২৬ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শেষ হতে চলেছে অমর একুশে বইমেলা। এবার শুরু থেকেই মেলা ছিল জমজমাট। তবে ছিল না নিয়ম-নীতির বালাই। এসব যেন দেখারও কেউ ছিল না। নোট, গাইড থেকে শুরু করে ইংরেজি শব্দের অভিধান, ইংরেজি ব্যাকরণ, আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য ক্যামব্রিজের পাইরেটেড বইয়ের ছড়াছড়ি মেলায়। নীতিমালার শর্তপূরণ না করেও মেলায় রয়েছে অনেক স্টল। একই আইএসবিএন ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক বইয়ে। এসব নিয়ম-নীতি ভঙ্গের জন্য প্রকাশনীগুলোকে শোকজের চিঠি দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি মেলা কর্তৃপক্ষ।

বইমেলাবিষয়ক নীতিমালার ৭.৩ ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘প্রকাশকগণ নোটবই, নোট, গাইড এবং পাইরেটকৃত বই সংরক্ষণ, প্রদর্শন বা বিক্রি করতে পারবেন না।’

নীতিমালায় আরও আছে, অন্য প্রকাশনীর বই পরিবেশক হিসেবে কেবল একটি স্টলেই বিক্রি করা যাবে। এ ধরনের কোনো বই কোনো স্টলে পাওয়া গেলে ওই স্টল তাৎক্ষণিক বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে এবং ওই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে উক্ত বৎসর এবং পরবর্তী এক বৎসরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হইবে।

প্রকাশকরা এসব নীতি ও নিয়ম মেনে চলবেন অঙ্গীকার করেই স্টল বরাদ্দ পেয়েছেন।

তবে সরেজমিনে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। নীতিমালায় গাইড জাতীয় বই বিক্রি বা প্রদর্শনের সুযোগ না থাকলেও অসংখ্য গাইড, গণিত, ইংরেজি ও কম্পিউটার শেখার বই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন স্টলে। বিক্রি হচ্ছে পাইরেটেড বই। নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে আইএসবিএন নম্বর নেই এমন বইও বিক্রি হচ্ছে মেলায়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৪৫ নম্বর স্টল দোয়েল প্রকাশনীর। এ স্টলে দেখা গেছে ‘১ মিনিটে ১০টি ইংলিশ শব্দ মুখস্ত হবেই!’ এমন বিজ্ঞাপনে ‘কুইক ভোকাবুলারি’র বই।

এছাড়া গ্রামার, ভোকাবুলারি, ভার্ব ডিকশনারি, এক মাসে টেনস শেখার ‘কুইক টেনস’সহ নানান গেমস প্যাকেজ ও গণিত শেখার বই। এ স্টলে সৃজনশীল বইয়ের সংখ্যাও হাতে গোনা। স্টলে পাঠকরা এলে সৃজনশীল বইয়ের চেয়ে ইংরেজি শেখার বইয়ের দিকে তাদের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে।

এ স্টলের বিক্রয়কর্মী তাসফিয়া জাগো নিউজকে বলেন, মেলার শুরু থেকেই আমাদের ইংরেজি শেখার বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে একপাশে গল্প-উপন্যাসের বইও রয়েছে।

আরও পড়ুন>> শিশুপ্রহর জমজমাট, বেড়েছে বই বিক্রি

মেলা প্রাঙ্গণের আরেকটি স্টল ফ্রেন্ডস বুক কর্নারে গিয়ে দেখা গেছে, ক্যামব্রিজের আইইএলটিএস শেখার বই। আইইএলটিএস রাইটিং মডিউল, কী টু ক্যাম্ব্রিজ আইইএলটিএসসহ ইংরেজি-বাংলা অনুবাদ ও ভোকাবুলারি শেখার নানান বই।

ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের ডিরেক্টর জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা অনেক বছর থেকেই মেলায় স্টল দিয়ে আসছি। এখন বই নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলবে। মানুষ না বুঝেই কথা বলে। আইইএলটিএস-এর যে বই আছে, সেগুলা বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, এগুলো ক্যামব্রিজের নয়।

দোয়েল, ফ্রেন্ডস বুক কর্নার ছাড়াও-এর বাইরে সিসটেক পাবলিকেশনস বিক্রি করছে কম্পিউটারসায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানান বিষয়ভিত্তিক বই।

হাতেখড়ি প্রকাশনীতে দেখা গেছে, আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা জ্যামিতি শেখার বই ‘স্কুল জ্যামিতি’। এ প্রকাশনীগুলো ছাড়াও মল্লিক ব্রাদার্স, প্রিয়মুখ, মুক্তচিন্তা, আবীর প্রকাশন, গণপ্রকাশনের স্টলে দেখা গেছে, ইংরেজি শিক্ষা, গণিত শিক্ষা আর হাতেখড়ির নানান বই বিক্রি হচ্ছে। চমন প্রকাশের স্টলে পাওয়া গেছে ‘গণিত শিক্ষা’র একাধিক বই।

সিসটেক পাবলিকেশনের বিক্রয়কর্মী মো. সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্রতিবছরই মেলায় স্টল থাকে। কম্পিউটারভিত্তিক বই বেশি বিক্রি হয়।

আরও পড়ুন>> চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে বইমেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে

এসব বই সৃজনশীল কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রকাশনীর মালিকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

এ বিষয়ে সিস্টেক পাবলিকেশনসের মার্কেটিং ম্যানেজার মিয়াজী জাগো নিউজকে বলেন, পাঠ্যপুস্তক ও নোট-গাইড ছাড়া যত বই আছে সব সৃজনশীল। আমাদের এখানে কম্পিউটারের বইগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। যারা এসব নিয়ে অভিযোগ তোলেন, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তারা সৃজনশীল বইয়ের সংজ্ঞাই জানেন না।

দোয়েল প্রকাশনীর প্রকাশক ফাতেমা জাহান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের লেখক ও অনেক গবেষণা করে বইগুলো লিখেছে। এগুলো কেন সৃজনশীল হবে না? বাংলা একাডেমীর কাছে সৃজনশীল বইয়ের সংজ্ঞা কী? গত দুই তিন বছর আগেও মেলা কমিটি আমাদের সতর্ক করে, আমরা যথাযথ উত্তর দিয়ে আসছি। আমাদের বইগুলোতে লেখা আছে জেডি ফাতেমা ফাউন্ডেশনের শিক্ষামূলক গবেষণাধর্মী বই। তাহলে কেন আমাদের সতর্ক করা হবে।

তিনি আরও বলেন, শিশু কর্নারে খেলনা গেমসধর্মী বই বিক্রি করছে। অনেক ইন্টারনেট থেকে প্রিন্ট করে বই বিক্রি করছে। সেগুলো কীভাবে সৃজনশীল বই হয়?

আরও পড়ুন>> ‘যাপিত জীবনের গল্প’র মোড়ক উন্মোচন করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

অন্যদিকে বইমেলার বাংলা একাডেমি অংশে মুক্তধারা নিউইয়র্কের স্টলে গিয়ে দেখা যায়, তাদের প্রকাশনীটির নিজস্ব প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে দশ থেকে বারোটি। বাকি বইগুলো অনন্যা, সময় প্রকাশন, তাম্রলিপি, ইত্যাদি, গ্রন্থপ্রকাশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীর। মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ জনপ্রিয় লেখকদের বিভিন্ন প্রকাশনীর বই ধার এনে বিক্রি করা হচ্ছে এ স্টলে।

মানা হচ্ছে না কপিরাইট আইন

এ বছর মেলায় কয়েকটি স্টলে কপিরাইট লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলেও সেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কপিরাইট অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক জানিয়েছেন, প্রকাশনীতে অভিযানে গিয়ে তারা নতুন বইগুলোর আইএসবিএন নম্বর নিরীক্ষা করেন। অনুবাদের বইয়ের ক্ষেত্রে বইয়ের মূল প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিপত্র দেখতে চাওয়া হয়, যা অনেক প্রকাশনী দেখাতে ব্যর্থ হয়। লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকের চুক্তিপত্র সঠিকভাবে হয়েছে কি না। প্রকাশক যত কপি বই প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে মোতাবেক বই প্রকাশ করা হয়েছে কি না তাও জানতে চাওয়া হয়। তবে তাতেও খুব বেশি ইতিবাচক ফল আসেনি।

তবে মেলায় এমন নিয়ম-নীতির লঙ্ঘনকে বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখছেন প্রকাশকরা। পুঁথিনিলয়ের প্রকাশক ও পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল জাগো নিউজকে বলেন, মেলায় ইংরেজি শেখার বই, গাইড জাতীয় বই অনেক বড় প্রকাশনী বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মেলা কর্তৃপক্ষ তাদের শোকজ করছে, যদি শাস্তি দেয় বা মেলা চলাকালীন স্টল বন্ধ করে দেয়, তাহলে মেলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে মেলা কর্তৃপক্ষ হয়তো মেলা শেষেই সিদ্ধান্ত নেবে।

মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, গত কয়েক বছর থেকেই মেলায় এমন নীতিমালার লঙ্ঘন হচ্ছে। বাংলা একাডেমি কোনো তদারকি ছাড়াই স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে। মেলায় যেন পাইরেটেড বই না থাকে এটাতো কর্তৃপক্ষের দেখা উচিৎ।

নীতিমালা অনুযায়ী কী ধরনের বই থাকবে, কোন ধরনের বই থাকবে না, এটার জন্যই তো কমিটি। তাদের এসব বিষয়ে নজর দেওয়া উচিৎ। আমরা প্রতিবছরই এসব বিষয়ে বলি, কিন্ত মেলা শেষ হয়, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নীতিমালা অনুযায়ী মেলা হলে একটি শৃঙ্খল মেলা হবে।

মেলা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগে টাস্কফোর্সের কমিটির সুপারিশে ১৯টি প্রকাশনীকে শোকজ করে মেলা পরিচালনা কমিটি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে শোকজ দেওয়া হয়। পাঁচটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সে চিঠির জবাবও দিয়েছে। এরপর গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) আরও সাতটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকেও শোকজ করে চিঠি দেয় মেলা পরিচালনা কমিটি। এরপর গত (১৮ ফেব্রুয়ারি) আরও সাতটি প্রকাশনীকে সতর্কবার্তা দেয় মেলা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ ১৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা এখনো জানায়নি মেলা পরিচালনা কমিটি।

এসব বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ম-নীতি ভঙ্গের অভিযোগে মাসব্যাপী আমাদের টাস্কফোর্স টিম তদন্ত করেছে। আমরা শোকজও করেছি। কিছু প্রকাশনী উত্তর দিয়েছে।

শোকজ করা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেলা পরিচালনা কমিটি প্রায় ৩২ সদস্য বিশিষ্ট। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে বাংলা একাডেমিসহ বসে নিতে হবে। ওই ১৯টি প্রকাশনীকে আবারও সতর্ক করা হয়েছে। আর মেলার পরে তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

আরএএস/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।