বিশ্ব বেতার দিবস

রেডিওর তরঙ্গে ভেসে আসে স্বাধীনতার ডাক

মামুনূর রহমান হৃদয়
মামুনূর রহমান হৃদয় মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০১:১১ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

১৯৭১ সাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা সময়। তখন তথ্য ও সংবাদের প্রধান মাধ্যম ছিল পত্রিকা, রেডিও আর সীমিত পরিসরের টেলিভিশন। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় পত্রিকা ও টেলিভিশনের ভূমিকা ছিল সীমিত-একদিকে সেন্সরশিপ, অন্যদিকে দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। এই সংকটকালে রেডিও হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অমূল্য হাতিয়ার, এক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাণভোমরা। এখান থেকেই প্রচারিত হতো মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ খবর, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার বার্তা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারিত মনোবল বৃদ্ধির কথামালা। রেডিওর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন কোথায় যুদ্ধ চলছে, কোথায় তাদের অবস্থান নিতে হবে। সাধারণ জনগণও রেডিওর তরঙ্গে শুনতেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, শত্রুর পরাজয়ের সংবাদ, বিজয়ের প্রতীক্ষা।

বিদেশি গণমাধ্যমও তখন বাংলাদেশকে তুলে ধরছিল বিশ্ববাসীর কাছে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করত, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ট্রানজিস্টর রেডিও। গভীর রাতে গোপনে রেডিও চালিয়ে শোনা হতো যুদ্ধের সর্বশেষ খবর, প্রতিরোধের বার্তা।

তথ্যসূত্র মতে, তৎকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আমজাদ আলী তার স্মৃতিকথায় মুক্তিযুদ্ধে রেডিওর অবদান সম্পর্কে বলেছেন, ‘তখন জুন মাসের শেষের দিক। প্রবল বর্ষায় আমরা ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামের আশপাশে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। চোখে ঘুম নেই, পরিবারের জন্য উদ্বেগ, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আমাদের খাবারের সংকট ছিল ভয়াবহ। কয়েক বাড়ি ঘুরে শেষমেশ এক গামলা মুড়ি আর এক টুকরো গুড় পেলাম। আধপেটা খেয়ে বসে আছি, মনে অজানা আশঙ্কা। এমন সময় কেউ একজন রেডিও চালিয়ে দিল। ভেসে এলো গান- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’

গানটা শুনে যেন আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, হতাশা উধাও হয়ে গেল। আমাদের সামনে ছিল বড় এক অপারেশন। সাহস সঞ্চয় করে আমরা পরদিন কাটাখালী ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়েছিলাম। অপারেশন সফল হয়েছিল, তবে নাজমুল শহীদ হলো।’

এই এক টুকরো স্মৃতিই বলে দেয়, মুক্তিযুদ্ধে রেডিও কেবল তথ্য বা বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, এটি ছিল অনুপ্রেরণার প্রতীক, বেঁচে থাকার ভাষা।

মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন রেডিও বাংলাদেশের প্রধান গণমাধ্যম হিসেবে টিকে ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদপোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়া মূলধারার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখন মানুষ আর রেডিওর অপেক্ষায় থাকে না; বরং স্মার্টফোনের মাধ্যমে মুহূর্তেই খবর পেয়ে যায়।

তবুও রেডিও তার অস্তিত্ব ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এফএম রেডিও এখন বিনোদনের মাধ্যমে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে-গান, আড্ডা, রেডিও জকিদের প্রাণবন্ত কথোপকথন রেডিওর জনপ্রিয়তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বিবিসি বাংলা এখনো সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বিভিন্ন রেডিও স্টেশন ডিজিটাল মাধ্যমেও নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে-মোবাইল অ্যাপে রেডিও শোনার সুবিধা, ফেসবুক-ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচার, এমনকি রেডিও অনুষ্ঠানগুলোকে পডকাস্ট আকারে শেয়ার করা হচ্ছে।

গণমাধ্যম বদলেছে, মানুষের তথ্য পাওয়ার অভ্যাসও বদলেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সংকটের মুহূর্তে রেডিও কখনোই হারিয়ে যায়নি-বরং নতুন রূপে ফিরে এসেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে রেডিও একাত্ম হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন এটি শুধু সংবাদ প্রচারের মাধ্যম ছিল না, তেমনি আজও এটি কেবল বিনোদন নয়-রেডিও এক ইতিহাস, এক আবেগ, এক লড়াইয়ের সঙ্গী।

কেএসকে/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।