ঘরে ‎ড্রিম ক্যাচার ঝুলিয়ে রাখেন, ইতিহাস জানেন কি?

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ১১ অক্টোবর ২০২৫

সাইমা হাসান

‘ড্রিম ক্যাচার’ শব্দটার সঙ্গে বর্তমানে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এটি একটি হস্তনির্মিত বস্তু, যা উইলো হুপের (উইলো গাছের ডাল দিয়ে তৈরি এক ধরনের বৃত্তাকার কাঠামো) উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এবং একটি শিথিল জাল দিয়ে বোনা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশেও অনেকের বাড়িতে গৃহসজ্জার একটি বস্তু হিসেবে এর দেখা মেলে। আবার অনেকে শখের বশে নিজ হাতেও এটি বানিয়ে থাকেন। তবে কখনো কি জানতে ইচ্ছা করেছে, এই ড্রিম ক্যাচারের উদ্ভব কোথা থেকে? বা এর পেছনের ইতিহাস কি? চলুন আজ জেনে নিই।

ড্রিম ক্যাচারের উৎপত্তি হয় ‘ওজিবওয়ে’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে, যারা উত্তর আমেরিকার গ্রেট লেক অঞ্চলের আদিবাসী। তবে প্যান-ইন্ডিয়ান আন্দোলনের পর ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে অন্যান্য আদিবাসী আমেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ে। তার মধ্যে একটি অন্যতম সম্প্রদায় ছিল ‘লাকোটা’। লাকোটাদের মধ্যেও এর ব্যবহার দেখা যায়। তাই তারাও নিজেদের ড্রিম ক্যাচারের কারিগর মনে করেন। এর কারণ সম্ভবত উত্তর সমভূমির সংস্কৃতি।

উত্তর আমেরিকার ‘ওজিবওয়ে’ যাদের পূর্বনাম ছিল ‘চিপেওয়া’ এবং ‘লাকোটা’ নামক এ দুটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীরাই মূলত ড্রিমক্যাচার তৈরি করতেন। তবে আধুনিক ইতিহাসে ড্রিম ক্যাচারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯২৯ সালে। ফ্রান্সিস ডেন্সমোর নামে একজন বিখ্যাত আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষাবিদ প্রথম এটি নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি শুরু করেন। সেই থেকেই ড্রিম ক্যাচার নিয়ে মানুষের আগ্রহ ক্রমে বেড়েই চলেছে।

ঘরে ‎ড্রিম ক্যাচার ঝুলিয়ে রাখেন, ইতিহাস জানেন কি?

আদিবাসী আমেরিকানরা স্বপ্নকে দেখতেন একধরনের শক্তি হিসেবে,যা ঘুমের সময় মানুষকে ঘিরে রাখে। তারা বিশ্বাস করতেন, রাতের বাতাস ভালো এবং খারাপ স্বপ্নে ভরা থাকে। তাই তারা ড্রিম ক্যাচারকে প্রথমে এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক তাবিজ হিসেবে তৈরি করেছিলেন। সাধারণত গোত্রের বয়স্ক নারীরা এসব ড্রিম ক্যাচার তৈরি করতেন। আদি আমেরিকানরা ঘুমন্ত মানুষদের; বিশেষ করে ঘুমন্ত শিশুদের খারাপ স্বপ্ন এবং মন্দ আত্মা থেকে রক্ষা করার জন্য এই ড্রিম ক্যাচারগুলোকে শিশুদের দোলনা বা বিছানার উপরে ঝুলিয়ে রাখতেন।

সেসময় কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন যে, এটি আধ্যাত্মিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। এই ড্রিম ক্যাচারটি ঘুমন্ত ব্যক্তির ভালো স্বপ্নগুলোকে জালে আটকে রেখে খারাপ স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করে দেয় বলে বিশ্বাস করা হতো। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন, খারাপ স্বপ্নগুলো এর কেন্দ্রের মধ্যকার গর্ত দিয়ে চলে যায় এবং ভালো স্বপ্নগুলো জালে সংরক্ষিত থাকে যা এর সঙ্গে ঝুলে থাকা পালকের মাধ্যমে নিচে শুয়ে থাকা ব্যক্তির কাছে চলে যায়। সুতরাং ড্রিম ক্যাচারকে এটি ছাঁকন যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে যায়, যা মানুষের স্বপ্ন ছাঁকবার কাজ করে।

প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় ড্রিম ক্যাচার। এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হতো যেন শিশুরা বড় হলে নিজে থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে তাদের একটা যোগসূত্র তৈরির কাজ করে এটি। ড্রিম ক্যাচারের ৫টি প্রধান প্রতীকী উপাদান রয়েছে কাঠামো বৃত্ত, জাল, পালক, পুঁতি এবং গিঁট সংখ্যা। এই উপাদানগুলো বিভিন্ন অর্থ বহন করে এবং ড্রিম ক্যাচারকে একটি বিশেষ অর্থ দেয়। সাধারণত একটি গোল বা ডিম্বাকার বাঁকানো উইলো গাছের ডাল দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে সেই বৃত্তের সাত বা আটটি স্থানে সাইনিউ (প্রাণীর কলা) বাঁধা হতো এবং সেটিকে টেনে মাকড়সার জালের মতো একটি নকশায় বুনা হতো, যার মাঝখানে থাকতো একটি ফাঁকা অংশ। হুপের নিচে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো পালক।

এখানে ড্রিম ক্যাচারের কাঠামো বৃত্তটি জীবনের বৃত্তাকার পথ, সূর্য ও চন্দ্রের প্রতিদিনের যাত্রা এবং মহাবিশ্বের প্রতীক। এটি সময়ের অবিরাম প্রবাহ এবং জীবনের ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। জালের মতো দেখতে অংশটি নেতিবাচক স্বপ্ন, চিন্তা এবং শক্তিগুলোকে আটকে দেয়, যা ভালো স্বপ্নগুলোকে আসতে দেয়। এটি সুরক্ষা এবং পরিশুদ্ধির প্রতীক। পালকগুলো বাতাস এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতীক, যা স্বপ্ন এবং আত্মাকে বহন করে।

বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকেরা বিভিন্ন ধরনের পালক ব্যবহার করে, যা তাদের নিজস্ব অর্থ বহন করে। এতে ব্যবহৃত পুঁতিগুলো স্বপ্ন বা অভিজ্ঞতা, যা জাল ভেদ করে চলে গেছে, তার প্রতীক। এগুলো সৌভাগ্য এবং সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ড্রিম ক্যাচারের জালের নকশা শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়; জালটি যেখানে কাঠামো বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, সেই সংযোগ গিঁট বা বিন্দুগুলোর সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে। যেমন: ৫টি গিঁট বিশিষ্ট একটি ড্রিম ক্যাচার একটি তারার প্রতীক, ৬টি গিঁট থাকলে তা একটি ঈগলকে প্রতিনিধিত্ব করে, ৭টি গিঁট থাকলে তা সাতটি ভবিষ্যদ্বাণীকে নির্দেশ করে, ৮টি গিঁট আদি আমেরিকান কিংবদন্তিতে মাকড়সা নারী ‘আসিবিকাশি’-র প্রতীক, এবং ১৩টি গিঁট বিশিষ্ট একটি ড্রিম ক্যাচার চাঁদের ১৩টি পর্যায়কে প্রতিনিধিত্ব করে।

এছাড়া এর নান্দনিকতা আরও বাড়িয়ে তুলতে ব্যবহার করা হতো ঝিনুক ও পাথর। বর্তমান সময়ে ড্রিম ক্যাচার তৈরিতে প্রাকৃতিক উপাদান তেমন একটা ব্যবহার হয় না এমনকি এর কাঠামোও নির্ভর করে শিল্পীর মন মতো। কিছু ড্রিমক্যাচারে এখন লাইট সিস্টেমও যুক্ত করা হচ্ছে, যা তাদের আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। তবে এখন ড্রিম ক্যাচার একটি সামান্য গৃহসজ্জার বস্তু মাত্র। কিন্তু ওইসময় সেই আদিবাসীদের কাছে এটি ছিল এক অলৌকিক শক্তির উৎস।

ঘরে ‎ড্রিম ক্যাচার ঝুলিয়ে রাখেন, ইতিহাস জানেন কি?

ড্রিমক্যাচার নিয়ে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের কিছু পৌরাণিক কাহিনি আছে। বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে মাকড়সাকে বিপদ কিংবা ভয়-ভীতির প্রতীক বলে মনে হয়, কিন্তু ওজিবওয়েরা এটিকে সুরক্ষা এবং সান্ত্বনার প্রতীক হিসেবে দেখে। ওজিবওয়ে ঐতিহ্যে ‘আসিবিকাশি’ নামক একজন রহস্যময় মাকড়সা নারীর কথা বলা হয়েছে। তিনি মাতৃত্বের প্রবৃত্তির প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং এই উপজাতির আধ্যাত্মিক রক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। মাতৃত্বের অধিকারী হওয়ায় তিনি বিশেষ করে ছোট শিশুদের যত্ন নিতেন ও তাদের নানা বিপদাপদ থেকে সুরক্ষা করতেন।

ওজিবওয়ে জনগণ যখন বেড়ে উঠছিল এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন উপজাতির সব সদস্যকে রক্ষা করা এবং তাদের দেখাশোনা করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। তার লোকেদের সাহায্য করার জন্য তিনি প্রথম ড্রিমক্যাচার তৈরি করেছিলেন এবং গোষ্ঠীর নারীদের এটি তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন। তার সম্মানে, মা এবং দাদিরা দূর থেকে তাদের সন্তান এবং পরিবারকে রহস্যময়ভাবে রক্ষা করার উপায় হিসেবে ড্রিম ক্যাচারগুলো পুনরায় তৈরি করেন। তাদের কাছে এটা একটা পবিত্র তাবিজ স্বরুপ। যদিও বর্তমানে মানুষ এটি ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে থাকে। জানালা বা বারান্দার দরজার উপর বাতাসে বাজে এমন ঝুমঝুমি এর মতো একটি সুন্দর শো-পিস হিসেবেই এর ব্যবহার ব্যাপক।

ড্রিম ক্যাচারের মনোমুগ্ধকর ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং পৌরাণিক কাহিনি অনুসন্ধানের পর এটা বলা বাহুল্য যে, আদিবাসী আমেরিকান জাতিগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক শিকড় থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বজুড়ে এর উপস্থিতি পর্যন্ত এই ড্রিম ক্যাচারটি যেন বিশ্বের মাঝে এক সেতুবন্ধন। এর প্রতিটি উপাদান, সূক্ষ্ম নকশা ও নান্দনিকতা সবকিছুরই রয়েছে গভীর তাৎপর্য। এটি শুধু একটি সৌন্দর্যমন্ডিত বস্তু নয়, বরং এটি মঙ্গলের প্রতীক।

আরও পড়ুন
এক কাপ কফির বিশ্বরেকর্ড
ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ যেখানে, নাক হারাতে বসেছিলেন রুহি চেনেট

লেখক: শিক্ষার্থী, অনার্স ৩য় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

কেএসকে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।