রাজধানীতে ফুরোচ্ছে পাখির আবাস
রাজধানী ঢাকা একসময় ছিল সবুজে ঘেরা, খোলা আকাশ ও প্রকৃতির স্পর্শে ভরা একটি শহর। সেই সময়ে ভোরের আলো ফুটলেই ঘুঘু, শালিক, দোয়েল আর চড়ুইয়ের কলতান জানিয়ে দিত নতুন দিনের আগমনী। নগরবাসীর সকাল যেন শুরু হতো তাদের সুরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা পরিণত হয়েছে কংক্রিটের এক বিশাল জনপদে যেখানে পাখিরা তাদের প্রাকৃতিক আবাস হারিয়ে দ্রুত এই শহর থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে নতুন বহুতল ভবন, সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প, শপিং সেন্টার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নের এই ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে পুরোনো গাছপালা, উজাড় হয়ে যাচ্ছে খোলা জায়গা। এতে গত ৫ বছরে রাজধানীতে সবুজের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, আর এর সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাখি তারা নিজেদের প্রাকৃতিক আবাস হারিয়ে ফেলছে।
একসময় যে শহরে পাখির ডাকেই মানুষের ঘুম ভাঙত। শিশুরা নানা প্রজাতির রং বেরঙের পাখির দেখা পেত সেই পরিচিত দৃশ্য এখন প্রায় হারিয়ে গেছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক ভবনগুলোতে পাখির বাসযোগ্য কোনা বা গর্ত থাকে না। ফলে ছোট পাখিরা শহরে টিকে থাকতে পারছে না। তার ওপর দূষণের মাত্রা যোগ হচ্ছে বাড়তি বিপদ হিসেবে। বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে প্রায়ই ঢাকার নাম উঠে আসে। শীতকালে বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যায়, যা পাখিদের শ্বাসপ্রশ্বাস, ডিম ফোটানো, বাচ্চা লালন-পালন, খাদ্য সংগ্রহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাশহুরা সাম্মি বলেন, ঢাকায় পাখির আবাস কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ দ্রুতগতির ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলতে গিয়ে অগণিত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, ফলে পাখিদের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া নগর উন্নয়নের নামে খাল, বিল ও নিচু অঞ্চলগুলো বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে দেওয়ায় পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আগে যেসব স্থানে পাখিরা নিরাপদ আশ্রয় পেত, পানি ও খাবার পেত, সেসব জায়গা এখন কংক্রিটে ঢেকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক মাশহুরা সাম্মি আরও বলেন, শুধু স্থানীয় পাখি নয়, বরং শীত মৌসুমে দূর-দূরান্ত থেকে আসা অতিথি পাখিরাও তাদের পরিচিত বিশ্রামস্থল হারিয়ে ফেলছে। তারাও এখন এই শহরে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ফলে রাজধানীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জেনে নেওয়া যাক যেসব কারণে কমছে পাখির আবাস-
১. দ্রুত নগরায়ন
শহরের প্রায় প্রতিটি খালি জায়গা ভবন, সড়ক, মার্কেট বা আবাসিকে রূপান্তর করা হচ্ছে। ফলে মাঠ, বাগান, ঝোপঝাড় বা গাছপালা সব জায়গায় এখন নির্মাণসামগ্রী, কংক্রিট এবং টাইলসে ভরা। ফলে পাখিদের জন্য উপযুক্ত বাসা বাঁধার স্থান আর থাকছে না।
২. গাছপালা নিধন ও সবুজায়ন সংকোচন
একসময় ঢাকার প্রতিটি অঞ্চলে বড় বড় গাছ দেখা যেত। এসব গাছে আবাস নিত দোয়েল, শালিখ, ঘুঘু, ফিঙে, টুনি, টিয়া, চড়ুইসহ অসংখ্য স্থানীয় পাখি। কিন্তু নির্মাণের প্রয়োজনে কিংবা সড়ক সম্প্রসারণের নামে এসব গাছ কাটা হয়েছে। শহরজুড়ে বড় গাছের সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রায় বিলীন হওয়ার দোরগোড়ায়। পাখিদের বেঁচে থাকার জন্য কেবল খাদ্যই নয়, তাদের প্রয়োজন নিরাপদ বাসস্থান, ডিম দেওয়ার স্থান, ছায়া এবং আবহাওয়ার প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ। গাছ না থাকা মানে তাদের জীবনের মূল ভিত্তি হারিয়ে যাওয়া।
৩. খাল-নদী ভরাট ও জলাধারের বিলুপ্তি
পাখিদের জন্য জলাধার ছিল খাদ্য সংগ্রহ, নিরাপদ পানি পাওয়া এবং আশ্রয়ের জায়গা। কিন্তু নগর উন্নয়নের নামে খাল ও জলাধার বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে। খালের জায়গায় তৈরি হয়েছে বিল্ডিং, সড়ক, মার্কেট বা বর্জ্য স্তূপ। এসব জলাশয় হারিয়ে যাওয়ার ফলে পাখিদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে।
৪. দূষণ
বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, আলোকদূষণ সবই রাজধানী ঢাকার স্বাভাবিক দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তিন ধরনের দূষণই পাখিদের জন্য ভয়ংকর। ধুলাবালিতে পাখিদের শ্বাসকষ্ট হয়, শব্দদূষণে তারা ভয় পায় এবং বাসা থেকে দূরে সরে যায়, আলোকদূষণে তাদের স্বাভাবিক ঘুমের চক্র বিঘ্নিত হয়, বর্জ্যে থাকা বিষাক্ত পদার্থ তাদের খাদ্যকে নষ্ট করে। সব মিলিয়ে পাখিদের প্রজননক্ষমতা কমে যাচ্ছে দ্রুত।
৫. খাদ্যাভাব ও অনিরাপদ পরিবেশ
ঢাকা শহরের কংক্রিটকেন্দ্রিক উন্নয়নে পাখিদের স্বাভাবিক খাদ্যের উৎস কমে গেছে। আগে যেসব ফল, বীজ, কেঁচো, পোকামাকড় ছিল প্রচুর। বাজার, আবর্জনার স্তূপ, ড্রেন সব জায়গাই দূষণে ভরা। ফলে পাখিরা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না, আবার যেটুকু পাচ্ছে তাও রোগজীবাণুযুক্ত হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
একইসঙ্গে মানুষের অসচেতন আচরণ ড্রোন উড়ানো, আতশবাজির শব্দ, ভবনে কাচের দেয়াল এসবও পাখিদের জন্য হুমকি। কাচে ধাক্কা লেগে অনেক পাখি মারা যায়। পাখি কমে গেলে শুধু পরিবেশ নয় মানুষের জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ে, গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
পাখি হারালে মানুষও তার শৈশব, প্রকৃতি ও ইতিহাসের এক বড় অংশ হারায়। পাখিরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তারা বেঁচে থাকলে শহরও বাঁচবে, পরিবেশও বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে। তাই পাখির আবাস রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, নয়তো ঢাকার আকাশেও পাখির ছায়া দেখা যাবে না আর কোনোদিন।
আরও পড়ুন
পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস
অনেকেই ভূমিকম্প টের পান না, কিন্তু কেন?
কেএসকে/জেআইএম