স্টেইনলেস স্টিলের যত কারিশমা

আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে বাড়ি-ঘরের গেইট, স্মৃতিস্তম্ভ, হাঁড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, তৈজসপত্র আর রান্নাঘরের যাবতীয় সামগ্রী এমনকি চামচের জগতে যে ধাতুর প্রসার সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়, তা হলো- স্টেইনলেস স্টিল। সংক্ষেপে বলা হয় ‘এসএস’। লোহাজাতীয় ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি যে কোনো জিনিসেই যত্ন-আত্তির অভাব হলে মরচে ধরে যেতে পারে। মরচে ধরে যাওয়া একটা সমস্যা। স্টেইনলেস স্টিল এক ধরনের বিশেষ ধাতব পদার্থ, যা মরচে ধরার সমস্যা থেকে মুক্ত। এতদিন যেখানে মেলামাইন, কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম আর লোহার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এখন সেখানে অবাক করার মতো নিরুপদ্রব সাদা চকচকে ধাতু স্টেইনলেস স্টিল আবির্ভাব ঘটায় ছড়িয়ে গেছে সবখানে। অতি সম্প্রতি ‘এসএস’র ব্যবহার বাটি-ঘটি, গাড়ির বাম্পার, বডি, দেওয়ালের প্রাচীর, গেইট ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই মোটেও।
স্টেইনলেস স্টিল আসলে একটি জিনিসের নাম নয়। স্টেইনলেস স্টিল একটি বহুমুখী উপাদান। লোহার যেসব শংকর ধাতুতে ক্রোমিয়াম থাকে, তার সবগুলোকেই স্টেইনলেস স্টিল নামে ডাকা হয়। যে স্টিলে মরচে পড়ে না এবং যার উচ্চমাত্রার তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে, তাকে স্টেইনলেস স্টিল বলে। পদার্থ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, গলিত লোহার মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফরাস যোগ করে ইস্পাত তৈরি হয়। সাধারণ ইস্পাত বা স্টিল স্টেইনলেস স্টিল নয়। এদের সঙ্গে স্টেইনলেস স্টিলের উপাদানের পার্থক্য রয়েছে। স্টেইনলেস স্টিল তৈরি করতে হলে লোহার সঙ্গে ক্রোমিয়াম, সামান্য নিকেল, সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ এবং কার্বন মিশিয়ে ধাতু শংকর করা দরকার।
স্টেইনলেস স্টিলে সাধারণত থাকে লোহা ৭০-৯০%, ক্রোমিয়াম ১২-২০% এবং ০.১-০.৭% কার্বন। স্টেইনলেস স্টিলে মরচে না পড়ার কারণ এতে ক্রোমিয়ামের ভাগ বেশি রয়েছে। এই ক্রোমিয়াম বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে ক্রোমিয়াম অক্সাইড। এই ক্রোমিয়াম অক্সাইড খুব সূক্ষ্ম স্বচ্ছ পর্দার আকারে স্টেইনলেস স্টিলের সমস্ত পৃষ্ঠতলকে ঘিরে রাখে। ফলে বাতাসের জলীয় বাষ্প বা অক্সিজেন এই পর্দা ভেদ করে ইস্পাতের সংস্পর্শে আসতে পারে না। ফলে মরিচা বা আয়রন অক্সাইড তৈরি হতে পারে না। যদি কোনোভাবে স্টেইনলেস স্টিলের গায়ে আঁচড় কেটে ক্রোমিয়াম অক্সাইডের অদৃশ্য পর্দাকে ছিন্ন করা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই আঁচড় কাটা জায়গার ক্রোমিয়ামের সঙ্গে নতুন করে বাতাসের অক্সিজেনের বিক্রিয়া হয় এবং নতুন ক্রোমিয়াম অক্সাইডের পর্দা তৈরি হয়ে ইস্পাতকে মরচে পড়ার হাত থেকে বাঁচায়।
সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ক্ষয়রোধি যে স্টেইনলেস স্টিল রয়েছে, তাতে লোহার সঙ্গে ১৪% ক্রোমিয়াম, ৮% নিকেল এবং ২-৩% মলিবডেনাম থাকে। শংকরায়নে কী কী ধাতু ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ওপর বিশেষ ধরনের স্টেইনলেস স্টিলের বিশেষ গুণাগুণ নির্ভর করে। অ্যালুমিনিয়াম, নাইট্রোজেন, ট্যাংস্টেন, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ তামা, টেন্টেলাম ইত্যাদি এসবের অন্তর্গত। তবে স্টেইনলেস স্টিলের মূল শংকরায়ন উপাদান হচ্ছে ক্রোমিয়াম। এই ক্রোমিয়ামই একে ক্ষয়কারী বিক্রিয়ার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করে। ধারণা করা হয়, স্টেইনলেস স্টিলের পৃষ্ঠদেশে বাতাসের অক্সিজেন ক্রোমিয়াম অক্সাইড তৈরি করে। একে আবৃত করে রাখে এবং অন্য বিক্রিয়া ও ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। তবে পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে, অন্তত ১২% ক্রোমিয়াম না থাকলে স্টেইনলেস স্টিলের মূল গুণগুলো দেখা দেয় না।
সব স্টেইনলেস স্টিলকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ধরা যাক- ফেরিটিক স্টিল। যাতে কার্বনের পরিমাণ খুব স্বল্প থাকে। মার্টেনস্টিক স্টিলে থাকে নিয়ন্ত্রিত কার্বনের সঙ্গে কিছু ম্যাঙ্গানিজ। ছুরি, কাঁচি, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও যন্ত্রপাতির চাকার বল ও বিয়ারিং তৈরিতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। অসটেনাইটিকে থাকে নিকেল ও মলিবডেনাম। অন্যান্য ধাতুও থাকতে পারে। এর চৌম্বকত্বের গুণাগুণ নেই। তাই রান্নার পাতিল তৈরিতে এটিই সাধারণত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
হাঁড়ি-কুড়ি, বাটি হিসেবে যখন স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহৃত হয়; তখন এমন কিছু ক্ষয়কারী পদার্থ রয়েছে যা এতে নেওয়া হয় না। কারণ এই স্টেইনলেস স্টিল বহু ধরনের রাসায়নিক শিল্পের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই সেখানে এর ক্ষয়রোধী গুণটি খুবই ভালো হওয়া প্রয়োজন। এজন্য একে সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণের দ্রবণে ডুবিয়ে ক্ষয় থেকে রক্ষাকারী আবরণটিকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করে নেওয়া হয়। তাতে অবশ্য চকচকে ভাবটি বেশ কিছু কমে যায়।
স্টেইনলেস স্টিলের একটা বড় গুণ হলো এগুলো জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য খুব কার্যকর উপযোগী নির্মাণ বস্তু। এর গায়ে এমন চকচকে পলিশ দেওয়া যায় এবং সে পলিশ বজায় রাখা সম্ভব হয়, যে জীবাণু জমার মতো খসখসে আশ্রয়স্থল তাতে সহজে মেলে না। এদিক থেকে এগুলো কাঁচ ও চকচকে চীনামাটির সমগোত্রীয়। তবে কাঁচ ও চীনামাটির চেয়ে অনেক বেশি টেকসই ও স্থায়ী। এই গুণের জন্য খাদ্য শিল্পে দুধ, মাখন, পনির ও আধুনিক শপিংমলের টিনজাত খাদ্য, পানীয় এবং ওষুধ শিল্পে স্টেইনলেস স্টিল জাতীয় পদার্থের ব্যবহার একেবারেই অপরিহার্য।
অবশ্য সব পরিস্থিতিতেই যে স্টেইনলেস স্টিল ক্ষয়রোধী তা বলা যাবে না। স্টেইনলেস স্টিলের জন্য লবণাক্ত পরিবেশ ভালো নয়। সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে রাখা হলে এটা ক্ষয় পায়। তাই সে ধরনের কোনো নির্মাণে এটা ব্যবহার করা হয় না। স্টেইনলেস স্টিলের চামচকে আপনি যদি আচারের বয়ামে বা ভেজা লবণের মধ্যে গুঁজে রাখেন, তা হলে শিগগিরই এটা বিকৃত হয়ে পড়বে। কারণ যে ক্রোমিয়াম অক্সাইডের আবরণ একে রক্ষা করার কথা। লবণের ক্লোরাইড তাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
আর হ্যাঁ। জোড়া দেওয়ার জন্য ওয়েল্ডিং করার প্রয়োজন হলে স্টেইনলেস স্টিলের ক্ষয়রোধী গুণ ওই জোড়ার আশেপাশে কমে যায়। উচ্চ উত্তাপ ও ধীর গতির শীতলীকরণের ফলে এ অঞ্চলে কার্বন ক্রোমিয়ামের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে ক্রোমিয়াম কার্বাইডে পরিণত হয়। এটা ক্ষয়ের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এ ক্ষেত্রে কার্বনের পরিমাণ কম রাখতে হয় ও টাইটেনিয়ামের মতো এমন একটা ধাতু যোগ করতে হয়, যার কার্বনপ্রীতি অক্ষোকৃত বেশি। ফলে ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম কার্বাইডের বদলে টাইটেনিয়াম কার্বাইড গঠিত হতে পারে।
স্টেইনলেস স্টিলের তাপ পরিবাহিতা কম। গরম গরম চায়ে স্টেইনলেস স্টিলের চামচ ডুবালে ওটা তাই অনায়াসে ধরা যায়। কিন্তু পাতিলে ব্যবহার করলে এই কম পরিবাহিতা অসুবিধাজন হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন চুলার উচ্চ আঁচে দুধ গরম করতে হলে স্টেইনলেস স্টিলের পাতিলে দুধকে নাড়াচাড়া না করে উপায় নেই। এজন্য তামার তলাযুক্ত স্টেইনলেস স্টিলের পাতিলই সর্বোত্তম। তবে খাবার সংরক্ষণের জন্য তামা, পিতল বা অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে স্টেইনলেস স্টিল অনেক ভালো। খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিষাক্ততা তৈরির সম্ভাবনা স্টেইনলেস স্টিলের মোটেও নেই। তাই হাসপাতালের খাবারের ট্রে, যন্ত্রপাতি সব কিছুই তৈরি হয় স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে।
উল্লেখ্য, ১৯০৪ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লেও খুলিত স্টেইনলেস স্টিল উদ্ভাবন করেন। ধাতব জগতে তাঁর এই দারুণ বৈপ্লবিক উদ্ভাবন ‘স্টেইনলেস স্টিল’ ১৯১২ সাল পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। স্টেইনলেস স্টিলকে সবার সামনে নিয়ে আসেন অ্যাডওয়ার্ড ম্যরের এবং বেনো স্ট্রস নামের দুই জার্মান। জার্মানির উদ্ভাবনের পর পরই স্টেইনলেস স্টিল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যবহার শুরু হয় শিল্পপণ্য হিসেবে। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন শিল্পে অসাধারণ সাফল্যের সাথে স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনে রয়েছে প্রাচীন মঙ্গোলিয়ান দিগ্বিজয়ী বীর চেঙ্গিস খানের ভাস্কর্য বা স্থাপত্যকর্ম। চীনাদের কাছে এই স্টিলের স্থাপত্যটি সতর্ক বুদ্ধিমত্তা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আজ বিশ্বব্যাপী নানা শিল্পকর্ম, বহু স্থাপত্য রয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের। বড় বড় অট্টালিকা, মার্কেট, বাড়ি-ঘর নির্মাণ কাজে স্টেইনলেস স্টিল এখন যথেষ্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। গত দু’দশকে উন্নত দেশে প্রস্তুত প্রায় সব রেলওয়ে কোচ স্টেইনলেস স্টিল দ্বারা তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশেও মেট্রোরেলের কোচগুলো আধুনিক স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি।
অবশ্য আগেই বলা হয়েছে, এর ক্ষয়ের সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলে অপেক্ষাকৃত পাতলা পাত নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই এসব কোচ তুলনামূলকভাবে ওজনে হালকা হয়ে থাকে। এতে রং দেওয়ার বা রক্ষণাবেক্ষণের কোনো দরকার পড়ে না। আজকাল স্থাপত্যশিল্প, সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরিতেও ব্যাপক আকারে স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থায়ী চকচকে সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করে এসব দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ও অট্টালিকা। সামুদ্রিক নির্মাণ ছাড়াও, গৃহস্থালী যন্ত্রপাতিগুলোয় ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হচ্ছে স্টেইনলেস স্টিল। আর তাই, স্টেইনলেস স্টিলের চাহিদা প্রতিবছর ৫% হারে বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিপুল সংখ্যক শিল্প স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করে। পরিসংখ্যানে প্রকাশ, স্টেইনলেস স্টিলের বৈশ্বিক উৎপাদন ৫২ মিলিয়ন টনের উপরে পৌঁছেছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্টেইনলেস স্টিলের আরেকটি ব্যতিক্রম ব্যবহার হলো শরীরের হাড়ের বিকল্প হিসেবে সংস্থাপন কাজে ব্যবহার। এ ধরনের ব্যবহারের বস্তুকে একেবারেই বিক্রিয়াহীন করে তৈরি করা হয়। মলিবডেনাম যুক্ত স্টেইনলেস স্টিল এ কাজের জন্য চমৎকার বলে বিবেচিত হয়েছে। শরীরের রস সমূহ অনেকটা লবণাক্ত বলে লবণ স্টেইনলেস স্টিলের অসুবিধাসমূহ বিশেষ ধাতু যোগ করে অতিক্রম করতে পারে। শরীরের মধ্যে ব্যবহৃত ধাতুকে অবশ্য শরীরের সমস্ত কিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে দীর্ঘদিন ক্ষয়হীন, স্বাস্থ্যসম্মত অবস্থায় থাকতে হয়। এমন অবস্থায় চিকিৎসা কাজে শরীরের হাড়ের বিকল্প হিসেবে স্টেইনলেস স্টিল ছাড়া অন্য কোনো জিনিস দ্বারা কি সম্ভব হতো?
এসইউ/এএসএম