বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস

ঈদে শুধু খাওয়াদাওয়া নয়, খাদ্য সচেতনতাও জরুরি

মামুনূর রহমান হৃদয়
মামুনূর রহমান হৃদয় মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৩:৩২ পিএম, ০৭ জুন ২০২৫

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যর এই পঙক্তি যেন আজও ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে। কবি এই লাইনেই তুলে ধরেছিলেন বাঙালির চিরন্তন বাস্তবতা। ক্ষুধা যখন তীব্র হয়, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে রূপসী জিনিসও রসহীন লাগে। তখন চাঁদও শুধু খাবারের প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে ওঠে, যেন একটি ঝলসানো রুটি। কবির সেই বেদনাবোধ আজ আর শুধুই সাহিত্যের নয়, এটি আমাদের খাদ্য-চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।

খাদ্য কেবল মুখরোচক কিছু নয়, এটি জীবন। খাদ্য কেবল স্বাদ নয়, এটি নিরাপত্তা। আর সেই নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস।

বিজ্ঞাপন

আজ ঈদুল আজহা। ইট-পাথরের দালানের ভেতর থেকে গন্ধ ভেসে আসবে রান্নার, ভাজাভুজির। ঈদের আনন্দে যেন টইটম্বুর রান্নাঘর। শিশুরা চিৎকার করে বলে, ‘ভালো লাগছে! চাওমিন আজ বেশি মজা!’ বড়রা বলে, ‘কোরবানির মাংসের স্বাদ যেন বেশি জমেছে!’ আমরা খাই, আদর করে খাইয়ে দেই, হাসি, আনন্দ করি। আজকের সবকিছুর কেন্দ্রে কিন্তু খাদ্য। মানুষ খাবার খেয়েই বাঁচে। আর ভালো খাবার খেয়েই আনন্দের গভীরতা বাড়ে।

তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে কেবল স্বাদের জন্যই কি আমরা খাই? না, খাদ্যের সঙ্গে যুক্ত আছে স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা আর মানবিকতা। আর এ কারণেই প্রতি বছর ৭ জুন পালিত হয় বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস। ২০২৫ সালের এবারের প্রতিপাদ্য ‘ফুড সেফটি: সায়েন্স ইন অ্যাকশন’ অর্থাৎ ‘নিরাপদ খাদ্য: বিজ্ঞানের প্রয়োগে নিরাপত্তা’।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

খাদ্য শব্দটি কেবল ক্ষুধা মেটানোর নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার, জীবনের স্পন্দন। আমরা যখন একটি প্লেটে ভাত তুলে নিই, তার পেছনে থাকে হাজারো হাতের শ্রম, জমির গন্ধ, সূর্যের আলো, সময়ের চাষ। একটি ভুলে সেই খাবার হয়ে উঠতে পারে বিষ। একটি অব্যবস্থাপনা অসুস্থতা ডেকে আনতে পারে গোটা পরিবারের বুকে।

আমাদের আশেপাশে প্রতিদিন খাবারের পসরা সাজে। রাস্তার পাশের হকার থেকে শুরু করে বিলাসবহুল হোটেল পর্যন্ত সবখানেই খাবার। কিন্তু কজন ভেবে দেখি, এই খাবার কীভাবে তৈরি হয়েছে? ব্যবহৃত তেল কতবার গরম করা হয়েছে? পানি কতটা বিশুদ্ধ? যে হাত পরিবেশন করছে, তাতে গ্লাভস কোথায়? জীবাণু আছে কি না?

একটু চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে হুট করে অসুস্থ হওয়া, পেটে ব্যথা, খাবার বিষক্রিয়া, ডায়রিয়া, এমনকি প্রাণঘাতী রোগও। এসব কেবল খাবারের স্বাদে নয়, আসে নিরাপত্তার অভাব থেকে। অথচ সামান্য সচেতনতায় এই ঝুঁকি কমানো যায় অনেকখানি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২৫ উপলক্ষে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, সুস্থ জীবনের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। তিনি মনে করিয়ে দেন, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাসে খাবারে লবণ কমানো, আঁশযুক্ত খাবার এবং পরিমিত শাকসবজি গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নীতিগত সহায়তা হিসেবে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের দিকেও জোর দেন তিনি।

বিজ্ঞানের এ যুগে খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। দরকার শুধু সদিচ্ছা। একটি রান্নাঘর পরিষ্কার রাখা, রান্নার আগে সবজি ধুয়ে নেওয়া, রান্নায় ব্যবহৃত উপাদানের মেয়াদ দেখা, শিশুকে বোঝানো বাইরের খাবার কেন না খাওয়া ভালো।

মজার ব্যাপার হলো, আমাদের পূর্বপুরুষেরা না জেনেই পালন করতেন অনেক স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। তারা খাবার ঢেকে রাখতেন, অন্যরা ঢেকে না রাখলে বকতেন। আগুনে ভালো করে রান্না করতেন, ‘হাফ বয়েল’ বুঝতেন না। খাবার পাত্র ধুয়ে সঠিক স্থানে রাখতেন। আজ বিজ্ঞান যা বলছে, তারা তা করতেন তাদেরও পূর্বপুরুষদের থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতায়। সেই ঐতিহ্য আজ বিজ্ঞান দিয়ে যাচাই হচ্ছে, প্রমাণ হচ্ছে...‘খাদ্য ও জীবন, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ একে অন্যের হাত ধরে চলে।

বিজ্ঞাপন

খাবার কেবল মুখের সুখ নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি। একটি শিশু পুষ্টিকর খাবার না পেলে যেমন তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তেমনি একটি জাতি যদি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না করতে পারে, তবে তার উন্নয়ন হবে পঙ্কিল ও ক্ষণস্থায়ী। খাদ্য নিরাপত্তা তাই আজ কেবল স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনার অংশ নয়, এটি অধিকার ও উন্নয়নের নৈতিক ভিত্তি।

একটি সুশীল সমাজের সূচনা ঘটে একটি পরিচ্ছন্ন থালা আর সঠিক রান্নার চামচে। এই ঈদের দিনে, যখন ঘরভর্তি খাবার আর হাসির উচ্ছ্বাস, তখন প্রয়োজন একটুখানি ভাবনার...আমাদের খাবারটা কি শুধু সুস্বাদু, নাকি নিরাপদও? আমরা যাকে ভালোবেসে মুখে তুলে দিচ্ছি, সে খাবার যেন হয় নির্ভরতার প্রতীক।

আজ ঈদের দিনে আমরা যদি শুধু মিষ্টিমুখ নয়, বরং মনের ভেতরে ছোট্ট একটি প্রতিজ্ঞা করি, ‘আজ থেকে খাবার শুধু খাবো না, বুঝে খাবো। নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।’ তবেই তো ঈদের আনন্দ পূর্ণ হবে...ভোজে নয়, বোধে।

বিজ্ঞাপন

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।