মানুষের ওজন মেপে পড়ার খরচ চালায় আসিফ

মিরপুর চৌদ্দ থেকে দশ নম্বরে যাচ্ছি হেঁটে হেঁটে। যাওয়ার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তেরো নম্বর বিআরটিএ সংলগ্ন রাস্তার পাশে এক কিশোর বই পড়ছে। সামনে ওজন মাপার যন্ত্র। কৌতূহল হওয়ায় কাছে গেলাম। বললাম, ‘ওজন মাপা যাবে?’ সে বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। বলল, ‘জ্বি ভাই, যাবে।’ আমি ওজন মাপলাম। মেপে বললাম, ‘কত টাকা?’ সে বলল, ‘ভাইয়া পাঁচ টাকা।’ টাকা দিয়ে পাশে বসলাম। বললাম, ‘কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে?’ বলল, ‘যাবে ভাই। তবে একটু তাড়াতাড়ি। আমাকে পড়তে হবে।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা। তোমার বেশি সময় নষ্ট করবো না।’
তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। গল্পসূত্রে জানতে পারলাম, ওর নাম শুভ ইসলাম আসিফ। বয়স ১৪ বছর। গ্রামের বাড়ি বরিশালের পটুয়াখালীতে। থাকে মিরপুর দশের সেনপাড়ায়। পড়াশোনা করে মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে। ওর বাবা নেই। ওজন মাপা যন্ত্র দিয়ে আয় করেই নিজের লেখাশোনার খরচ চালায়। মা আছেন। মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করেন। সপ্তাহখানেক আগেই মাকে একটি ভ্যানে করে জুতা-স্যান্ডেল বিক্রির দোকান করে দিয়েছে। গল্পের মাঝেই আসিফ চার-পাঁচ জনকেও বিদায় করল।
আসিফ চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে মামার ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে রাস্তায় বসেছিল। সেদিন আয় হয়েছিল প্রায় ১০০ টাকা। সেদিনই আসিফের মাথায় বুদ্ধি এলো, পড়াশোনার ফাঁকে তো এ কাজ করতেই পারে। তাহলে এ থেকে কিছু আয়ও হবে, পড়াশোনা করতেও সুবিধা হবে। তখন থেকেই স্কুল শেষে বিকেল থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত এখানেই ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকে। ওজন মাপতে জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে নেয়। আগে নিতো দুই টাকা করে। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সে পাঁচ টাকা করে নেয়। ওজন মেপে এখন দৈনিক আয় হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
আসিফ বলেন, ‘আমার বাবা নেই। মা মানুষের বাসায় কাজ করেন। তা দিয়ে কোনোমতে খাওন খরচ চলে। তাই আমি নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে রাস্তায় বসেছি। এখানেই আমি পড়ালেখা করি। স্কুল ছুটির পর বসলে বাসায় পড়ালেখা করার তেমন সুযোগ পাই না। তাই বই, ব্যাগ আর ওজন মাপার মেশিন নিয়ে একবারে চলে আসি। এখানেই পড়ালেখা করি। মানুষের ওজন মেপে আয় করি। এই আয় দিয়েই এখন পড়ালেখা করি। পড়ালেখার খরচ চালায়ে কিছু টাকাও জমা করছি ভবিষ্যতের জন্য।’
আসিফের মামা সাগর ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমার ভাগ্নে প্রায় চার বছর ধরে এ কাজ করে পড়ালেখার খরচ চালায়। প্রথমে আমার ওজন মাপার পুরাতন যন্ত্র দিয়েই শুরু করেছিল। পড়ে তার মায়ের জমানো ৯০০ টাকা দিয়ে ওজন মাপার যন্ত্র কিনে নিয়মিত কাজ করে। আমি অনেক খুশি যে, আমার ভাগ্নে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করছে। নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছে। এই বয়সের বাচ্চারা অনেকেই নেশাখোর হয়। আমার ভাগ্নে সবার চেয়ে আলাদা। সে এগুলো না করে স্কুল ছুটির পর ফাঁকা টাইমে ইনকাম করছে।’
আসিফের মা আছিয়া বেগমের পানির ট্যাংকির গলিতে জুতা-স্যান্ডেলের অস্থায়ী দোকান। কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পোলার পড়ালেখার খরচ দিতে পারি না। পোলাই তার পড়ালেখার খরচ চালায়। মানুষের বাসায় কাম করে আর কয় টাকা আসে কন! বাজারের যে দাম। তা দিয়ে খামু, নাকি ছেলেরে পড়ামু। তবে আমার ছেলে আজ কয়েক বছর ধরে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালায়। কিছু টাকাও জমায়। পোলার ও আমার কিছু জমানো টাকা দিয়েই একটা ভ্যান গাড়ি নিয়ে এই দোকান দিলাম। দোকান দেওয়ার কেবল কয়েকদিন হলো। এখনো তেমন বেচাকেনা শুরু হয়নি।’
আসিফের মায়ের ইচ্ছা, আসিফ পড়াশোনা করে পুলিশ হবে। কিন্তু আসিফের ইচ্ছা, সে আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার ইচ্ছা, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সে তার মাকে নিয়ে জায়গা কিনবে। সুন্দর ডিজাইনের একটা বাড়ি করবে। সুখে-শান্তিতে সেই বাড়িতে মাকে নিয়ে থাকবে। আমরাও চাই আসিফদের চাওয়া পূরণ হোক, মাকে নিয়ে সুখে থাকুক।
এসইউ/এমএস