নিজে থেকেই সেরে যায় সোয়াইন ফ্লু

সোয়াইন ফ্লু নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নিজে থেকেই সেরে যায় সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ পজিটিভ)-এর সংক্রমণ। তার উপর, সোয়াইন ফ্লু এড়ানোর জন্য মাস্ক ব্যবহারেরও প্রয়োজন নেই।
অথচ, সোয়াইন ফ্লুয়ের জন্য সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশই যারপরনাই আতঙ্কিত। এমনও মনে করা হচ্ছে, বাস-ট্রেন সহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ব্যবহারের সময়েও, অজান্তে সোয়াইন ফ্লুয়ের সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে৷কিন্তু, এই ধরনের ভাবনাও সঠিক নয়। সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কিত এমনই বিভিন্ন বিষয় উঠে এলো।
www.kolkata24X7.com-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সোসাইটি ফর সোশ্যাল ফার্মাকোলজির সংগঠক তথা কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ওষুধবিজ্ঞান বিভাগের প্রশিক্ষক ডাক্তার স্বপনকুমার জানা জানালেন সোয়াইন ফ্লুর কথা।
তাঁর কথায়, ২০০৭-এ সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ পজিটিভ)-এর মারাত্মক প্রকোপ দেখা গিয়েছিল ফিলিপাইনে। তার পর ২০০৯ সালে। ওই বছর ফের সোয়াইন ফ্লুয়ের ভাইরাস এইচ১এন১ পজিটিভের মারাত্মক প্রকোপ দেখা দেয় উত্তর আয়ারল্যান্ডে। যদিও, ২০১০ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দাবি করে, এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু, তার পরেও এই ২০১৫-তে ফের সোয়াইন ফ্লুয়ের মারাত্মক প্রকোপ দেখা দিলো। এ বার ভারতে।
প্রশ্ন : শুধুমাত্র জীবিকার জন্য নয়। অন্য নানা কারণেও প্রতিদিন ঘরের বাইরে বের হন বহু মানুষ। এ দিকে, সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ পজিটিভ) হলে কী, কী করা উচিত, সে সব বিষয়ে ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমেও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে৷ অথচ, সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশেরই প্রশ্ন, কীভাবে সোয়াইন ফ্লুয়ের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব? কারণ, প্রতিদিনই ভিড়ে ঠাসা অথবা ফাঁকা বাস-ট্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ব্যবহার করেন বহু মানুষ। অথচ, কোনো সহযাত্রী এইচ১এন১ পজিটিভ-এ আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, তা বোঝাও সম্ভব নয়৷ওই সহযাত্রী নিজেও হয়তো জানেন না, যে তিনি এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের শিকার। তা হলে কি ওই সহযাত্রীর হাঁচি-কাশি থেকেও অন্য কোনও যাত্রীর শরীরে ঘটে যেতে পারে সোয়াইন ফ্লুয়ের সংক্রমণ?
উত্তর: এমনটা আসলে হওয়া সম্ভবই নয়৷ যদিও, গোটা দেশে এখনও পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ পজিটিভ)-এ মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১,২০০। এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গে এর মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দু’শো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১ পজিটিভ)-এ মৃত্যুর সংখ্যা আট। এমন সব তথ্য সত্ত্বেও, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঘরের বাইরে বের হওয়া এবং ভিড়ে ঠাসা যানবাহন ব্যবহার করলেও, সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণের কোনো ভয় নেই৷
প্রশ্ন: কেন?
উত্তর: কারণ, ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিজে থেকে সেরে যায় এইচ১এন১ পজিটিভ-এর সংক্রমণ। এমনও হয়, কারও শরীরে হয়তো এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাস আক্রমণ করেছে, কিন্তু তখনো তিনি নিজেও জানেন না (তাঁর পক্ষে জানা সম্ভবও নয়)। কাজেই, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই৷
প্রশ্ন: তা হলে, ঘরের বাইরে বের হলে সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয়-ই নেই?
উত্তর: একেবারেই নয়। তবে, সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকার জন্যেও কেউ সোয়াইন ফ্লুয়ের শিকার হতে পারেন। এ দিকে, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা যাঁদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক কম, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণত অপুষ্টির শিকার। অনাহারী অথবা অর্ধাহারী কিংবা গৃহহীন ওই সব মানুষ সাধারণত ভিড়ে ঠাসা ট্রেন-বাস (কলকাতায় ট্রাম) অথবা অন্য কোনও যানবাহন ব্যবহার করেন না।
প্রশ্ন: সোয়াইন ফ্লু এড়ানোর জন্য মাস্ক কি প্রয়োজন?
উত্তর: একেবারেই নয়। মাস্ক পরলেও এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব নয়। মাস্কে মিথ্যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়৷
প্রশ্ন: তা হলে তো, প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণও নিষ্প্রয়োজন?
উত্তর: মোটেও নয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। তবে একই সঙ্গে, আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কারণ, শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাস কাকে, কতটা আক্রমণ করতে সমর্থ হবে। শিশু আর যাঁরা অপুষ্টির শিকার এবং ক্যানসার, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য কয়েকটি অসুখে আক্রান্ত, তাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণত রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো সোয়াইন ফ্লু আক্রান্তের হাঁচি-কাশি থেকে সংক্রমণের আশঙ্কাও বেশি থেকে যায়। যে কারণে, সতর্ক থাকতে হবে। কারও সর্দি-কাশি হলে, স্বাভাবিকভাবেই হাঁচি-কাশির সময় তিনি মুখে রুমাল চাপা দেন (খুব কম ক্ষেত্রে এই ধরনের অভ্যেস দেখা যায় না)। তবে, খাবার আগে সকলেরই ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত৷
প্রশ্ন: কিন্তু, যদি কারও সর্দি-কাশি লেগে যায়, তা হলে, ওই পরিস্থিতিতে তিনি কি এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের শিকার হতে পারেন?
উত্তর: কোনো একটি জীবাণুর সংক্রমণ হলে, সাধারণত অন্য কোনো জীবাণুর সংক্রমণ সম্ভব নয়। তবে, কারও যদি সর্দি-কাশি হয়, তা হলে বেশি পরিমাণে জল পান করতে হবে। তার সঙ্গে বিশ্রাম এবং স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে।
প্রশ্ন: আর, সঙ্গে জ্বর থাকলে?
উত্তর: জ্বর যদি ১০২ ডিগ্রির বেশি থাকে, তা হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে৷দিনে সর্বাধিক তিনবার খাওয়া যেতে পারে। জ্বর কমে গেলে অথবা ১০২ ডিগ্রির কম জ্বর থাকলে, ওই ওষুধ খাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন: জ্বর কমানোর জন্য কি প্যারাসিটামল-ই খেতে হবে?
উত্তর: প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ অনেক বেশি নিরাপদ৷তা ছাড়া, খালি পেটেও এই ওষুধ খাওয়া যায়৷তাই, এই ওষুধই খাওয়া উচিত।
প্রশ্ন: কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার এমন প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, সোয়াইন ফ্লুয়ের ভাইরাস এইচ১এন১ পজিটিভ বিনাশকারী ওসেলটামিভির জাতীয় ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই খেয়ে নিচ্ছেন রোগী…
উত্তর: এই ধরনের প্রবণতা কোনোমতেই থাকা উচিত নয়। এইচ১এন১ পজিটিভ বিনাশকারী ওসেলটামিভির জাতীয় ওষুধ অর্থাৎ, অ্যান্টি ভাইরাল না খাওয়াই ভালো। কারণ, সোয়াইন ফ্লুয়ের জন্য এ বার যে এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাস-ই দায়ী, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও তথ্য জানা যায়নি। এই ভাইরাস নিজেদের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন করে নিতে পারে। তার উপর, এ বারের সোয়াইন ফ্লুয়ের প্রকোপ কোন শ্রেণির এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের কারণে হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত তাও জানা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, এইচ১এন১ পজিটিভ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে এটা নিশ্চিত না হয়ে, কোনোমতেই নিজে থেকে ওসেলটামিভির জাতীয় ওষুধ খাওয়াও উচিত নয়। তা ছাড়া, এইচ১এন১ পজিটিভের সংক্রমণের পরেও, সাধারণত ওই অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতেও হবে।
প্রশ্ন: জ্বর-সর্দি-কাশি সহ সোয়াইন ফ্লুয়ের অন্যান্য উপসর্গও দেখা দিল। কিন্তু, সোয়াইন ফ্লুয়ের সংক্রমণ হয়েছে কি না, তা কীভাবে বোঝা সম্ভব?
উত্তর: সোয়াইন ফ্লুয়ের ভাইরাস এইচ১এন১ পজিটিভ কি না, তা নির্ণয় করতে হলে সন্দেহজনক রোগীর সোয়াব টেস্ট করাতে হবে। গলা এবং নাকের ভিতর যে শ্লেষ্মা থাকে, তার নমুনাই পরীক্ষা করে দেখা হয়। জ্বর-সর্দি-কাশি হলে যদি পাঁচ-সাতদিনের মধ্যে তা না কমে, তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সোয়াব টেস্ট করাতে হবে।
প্রশ্ন: কীভাবে সোয়াইন ফ্লুয়ের সংক্রমণ ছড়াতে পারে?
উত্তর: সোয়াইন ফ্লুয়ের ভাইরাস এইচ১এন১ পজিটিভ-এর সংক্রমণ সাধারণত শুয়োর থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায় না। একসময় অবশ্য খুব কম ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। তবে, এখন সাধারণত মানুষ থেকে মানুষের শরীরেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা সময় আবার নিজে থেকেই এই ভাইরাসের প্রকোপ কমে যাবে। কিন্তু, প্রতিপালনের জন্য যাঁরা অনেক বেশি সময় ধরে শুয়োরের সঙ্গে থাকেন, তাঁদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
বিএ/পিআর