আলু দিবস

আধুনিক সভ্যতায় আলুর অবদান

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ৩০ মে ২০২৪

গরুর মাংসে, যে কোনো মাছের সঙ্গে তরকারি কিংবা সকালের নাস্তায় আলু ভাজি, ভর্তা খেতে নিশ্চয়ই পছন্দ করেন। এছাড়া আলুর চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা ম্যাশ পটেটোর মতো বিভিন্নভাবে আমাদের রসনা মেটায় আলু। পুষ্টিগুণে ভরপুর আলু শুধু আমাদের বাঙালির নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের খাদ্যতালিকায় থাকা প্রধান একটি খাদ্য উপাদান।

কিন্তু কীভাবে খাদ্য তালিকায় এলো মাটির নিচে জন্মানো এই আলু, জানেন কি? কীভাবে এত জনপ্রিয় হলো পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে? আলু কিন্তু আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠতেও সাহায্য করেছে অনেকভাবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক আলু আবিষ্কার এবং কীভাবে আধুনিক সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে আলুর অবদান রেখেছে।

আধুনিক সভ্যতায় আলুর অবদান

আজ ৩০ মে কিন্তু আলু দিবস। খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (এফএও) সমর্থনে এই দিনটি প্রতিষ্ঠা করে জাতিসংঘ। মূলত পুষ্টিগুণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আলুর তাৎপর্যপূর্ণ সুবিধাগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই এ সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া দিনটি কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আলুর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়।

আরও পড়ুন

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক আলু প্রথম কোথায় আবিষ্কার হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, আলু সর্বপ্রথম আন্দিজ পর্বতমালায় বসবাস করা ইনকা সভ্যতার মানুষেরা খাওয়া শুরু করে। প্রায় ৮০০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার চূড়ায় সর্বপ্রথম পেরুভিয়ানরা আলুর চাষ শুরু করে।

ইনকা সভ্যতার শ্রমজীবী মানুষদের খাবারের একটি যথাযথ উৎস ছিল আলু। আলুর মধ্যে থাকা পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, জিংক, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, পর্যাপ্ত চর্বি, মিনারেল এবং ভিটামিন তাদের শক্তির যোগান দিত। আলু খাওয়ার ফলে দীর্ঘসময় পেট ভরা থাকত। ফলে তারা অনেক বেশি পরিশ্রম করতে পারতেন। ইনকা সভ্যতার মানুষেরা পাহাড়ের খাদে আলু চাষ করত।

তবে ঐতিহাসিকরা এখানে যে আলুর সন্ধান পেয়েছেন তা আড়াই বছর আগের। ধারণা করা হয় ইনকাদের আলু সংরক্ষণের ভালো পদ্ধতি জানা ছিল না। এজন্য ৮ হাজার বছর আগের আলুর নমুনা তারা পাননি। তবে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এবং বলিভিয়াতে প্রাচীন কিছু মাটির পাত্র পাওয়া গেছে যেগুলোতে আলুর ছবি আঁকা ছিল। তাই ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে আলু ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা আলুকে বিনয়ের প্রতীক মনে করত।

আধুনিক সভ্যতায় আলুর অবদান

দক্ষিণ আমেরিকার ইন্ডিয়ানা জাতির কাছে আলু ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা আলুকে কামাটা বা বাটাটা বলতো। ধারণা করা হয় এখান থেকেই আলুর ইংরেজি নাম পটেটো এসেছে। তারা আলু দিয়ে এক ধরনের পানীয় বানিয়ে খেত, যা অনেকটা বিয়ারের মতো স্বাদের। এছাড়া এই অঞ্চলের মানুষই আলু দিয়ে নানান ধরনের খাবার তৈরি করা শুরু করে। এমনকি বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষও শুরু করেছিলেন ইন্ডিয়ানারা।

ধীরে ধীরে পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় আলু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে ইউরোপিয়ানরা আলুর পানশে স্বাদের জন্য খুব একটা পছন্দ করত না। তারা আলুর গাছ বাড়ির বাগানে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগাত। তবে ইউরোপের আবহাওয়ায় আলুর মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল ২০০ বছর।

আরও পড়ুন

ইউরোপে আলুর আগমন ঘটে স্পেনের নাবিকদের হাত ধরে। ইউরোপে উচ্চবিত্তদের কাছে আলু পানসে সবজি হলেও সহজলভ্য হওয়ায় নিম্নবিত্তরা আলুকে বেশ দ্রুত সাদরে গ্রহণ করেছিল। ১৭৫০ এর শুরুর দিকে অত্যন্ত সহজলভ্য হওয়ায় মহামারির মাঝে এই অবহেলিত আলুই হয়ে ওঠে ইউরোপের একমাত্র সম্বল। এর ফলে অন্যান্য খাবারের অপ্রতুলতা সৃষ্টি হলেও আলুর কল্যাণে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা স্বাভাবিক গতিতেই বাড়তে থাকে। আলু খেয়ে সন্তুষ্ট থাকা এসব কৃষক, শ্রমজীবী এবং সৈনিকদের কাধে চড়েই ব্রিটিশ,ডাচ এবং জার্মানদের মত পরাশক্তিগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

আয়ারল্যান্ডে আলু প্রবেশের পরপরই প্রায় ১৫৯০ থেকে ১৮৪৫ সালের মধ্যে তাদের জনসংখ্যা ১০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখে দাঁড়ায়। আলুই হয়ে ওঠে তাদের মূল খাদ্যের উৎস। কিন্তু এর পরেই বাঁধে বিপত্তি। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে আলুর গাছে দেখা দেয় আলুর ভয়ংকর ব্লাইট রোগ। ইতিহাসে এটিকে একটি মারাত্মক মহামারি হিসেবে ধরা হয়। কেননা প্রায় ১০ লাখের বেশি আইরিশ তখন না খেতে পেয়ে মারা যায়। এছাড়া আরও ২০ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়।

আধুনিক সভ্যতায় আলুর অবদান

১৯১০ সাল নাগাদ ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষের পরিমাণ আবারও বাড়তে থাকে। শ্রমজীবী মানুষের এই বিশাল গ্রুপের খাদ্যের যোগান হিসেবে প্রচুর পরিমাণে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ইউরোপের নতুন গড়ে ওঠা ফ্যাক্টরিগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষ জনবলের সৃষ্টি হয়। আর এই জনবলের হাত ধরেই পরবর্তীতে ইউরোপে আসে শিল্প বিপ্লব, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় পুরো বিশ্বে এবং এই শিল্প বিপ্লবই আমাদেরকে এনে দিয়েছে আধুনিক সভ্যতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের প্রধান খাদ্য ছিল আলু। বাংলায় অর্থাৎ ভারতবর্ষে ৫০০ বছর আগে পর্তুগিজদের হাত ধরে আসে আলু। ২০ মে, সাল ১৪৯৮। এই দিনটিতে ভারতবর্ষের কালিকট বন্দরে পৌঁছান পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামা। আবিষ্কার করেন ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের সরাসরি জলপথ। পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে এসেছিল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে।

এখানকার মশলা ও রেশমের বেশ কদর ছিল ইউরোপে। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের এসব কিনতে হতো আরব বণিকদের মাধ্যমে। এ মশলার বাজার ধরতেই পর্তুগিজদের আগমন ঘটে ভারতবর্ষে। তাদের হাত ধরেই বাংলায় আলু আসে। এখানকার আবহাওয়া এবং মাটি আলু চাষের জন্য খুবই উপযোগী হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে আলু চাষ করার প্রবণতা বাড়ে। সেই সঙ্গে ব্যাপক ফলনের কারণে দামও হয় হাতের নাগালে। সহজলভ্য হওয়ায় বাংলার কৃষকশ্রেণি এবং নিম্নবিত্তদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় স্থান পায় আলু।

আরও পড়ুন

সূত্র: ন্যাশনাল টুডে, হিন্দুস্থান টাইমস

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।