ওমিক্রন কি নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে?
কবে শেষ হবে করোনার দাপট, কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবো- মনের ভেতর এ প্রশ্ন নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে উত্তরটা ঠিকঠাক জানা নেই কারোরই। পৃথিবীর ওপর থেকে করোনার কালো ছায়া কবে সরবে, সেটা বলা কঠিন। ‘হয়তো খুব শিগগির’- বিজ্ঞানীরা এমন আভাস দিচ্ছেন। এমনও বলা হচ্ছে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবের মধ্য দিয়েই শান্ত হবে করোনার মহামারি কাল।
তবে কি করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে? প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অতি সংক্রামক এ ভ্যারিয়েন্ট প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর বাংলাদেশেও এমন ইঙ্গিত হাওয়ায় ভাসছে। গত কদিনে ঢাকাসহ সারাদেশে করোনা সংক্রমণ কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় গুঞ্জনের পালে হাওয়ার জোর বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২৮ জানুয়ারি দেশে ৪৬ হাজার ২৯২ জনের নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে ৪৬ হাজার ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় নতুন ১৫ হাজার ৪৪০ জন রোগী শনাক্ত হয়। সে হিসাবে প্রতি ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ৩৩.৩৭ শতাংশ।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পর গতকাল শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দেশে একদিনে ৩৯ হাজার ৭২৬টি নমুনা সংগ্রহ ও ৩৯ হাজার ৪৪৫টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে নতুন রোগী শনাক্ত হয় ৯ হাজার ৫২ জন। এ হিসাবে প্রতি ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
করোনার প্রতিদিনের সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, টানা ১২ দিন দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে থাকলেও ৪ ফেব্রুয়ারি তা ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে।
তবে এ মহামারিকালে দেশের স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা শোনাচ্ছেন আশার কথা। তারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ওমিক্রনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। অতীতেও দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ কমলে বাংলাদেশেও কমে। গতকাল ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ হার ২০ শতাংশের বেশি (২২ দশমিক ৯৫ শতাংশ) থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে দেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীকাল রোববার থেকে দৈনিক সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বোঝা যাবে, দেশে ওমিক্রন তথা করোনার সংক্রমণ কমে আসছে। তবে করোনা সংক্রমণ হ্রাস পাওয়া না-পাওয়া দেশের মানুষের সচেতনতা ও টিকাগ্রহণের ওপর নির্ভর করবে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি টিকাগ্রহণের হার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে করোনার ভয়াবহতা কমিয়ে আনা যেতে পারে।
দেশে করোনার সংক্রমণ কি কম আসছে, এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড এ.এস এম আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, তুলনামূলকভাবে সংক্রমণ কমলেও এখনই নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। শনাক্তের হার ৩৩ শতাংশের বেশি থেকে ২২ দশমিক ৯৫ শতাংশে নামলেও এখনো সংক্রমণের এ হার অনেক বেশি।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে আরও ৫/৭ দিন সর্তকতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আবারও যে সংক্রমণ বাড়বে না, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে জনগণকে স্বাস্থ্যাবিধি মানার ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি টিকাগ্রহণের হারও দ্রুত বাড়াতে হবে। আর সেটি করতে পারলেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আগামী সপ্তাহেই (রোববার থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহ) স্পষ্ট হয়ে যাবে আমরা করোনার পিক সংক্রমণ অতিক্রম করে ফেলেছি কি না।
নতুন করে সংক্রমণ বাড়ার কোনো আশঙ্কা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাবের সময় একবার সংক্রমণ কমে আবার বেড়েছিল। ফলে সংক্রমণ কমলেই যে পরবর্তীতে বাড়বে না এমনটা বলা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গে ওমিক্রণের সংক্রমণ কমে আসায় দেশেও সংক্রমণ কমার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে ড. মুশতাক বলেন, সংক্রমন কমে গেলেও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব করোনা প্রতিরোধী টিকা নিতে হবে।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই বছরের শেষ দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমলেও গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত করোনার ডেল্টা ধরন ব্যাপক আকার ধারণ করে। বছরের শেষ কয়েক মাস পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়। তবে এ বছরের শুরু থেকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার প্রাদুর্ভাব আবারও দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
গত ডিসেম্বরের শুরুতেও দেশে করোনা শনাক্তের হার ১ শতাংশের ঘরেই ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে সংক্রমণে ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। জানুয়ারির মাঝামাঝির পর করোনার অতি সংক্রামক ধরন ওমিক্রনের দাপট বাড়ে। এতে মাসখানেকের মধ্যেই দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ে কয়েকগুণ। করোনার বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ চলছে। ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে ১৩ জানুয়ারি থেকে সরকার বিধিনিষেধ জারি করে। বর্ধিত এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে স্কুল-কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৮ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৮ হাজার ৫২৪ জন। সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭৪ জন।
এমইউ/এমকেআর/এএসএম