দেশজুড়ে

সরকার-পাইকারের মাঝে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা চামড়া ব্যবসায়ীরা

সরকার-পাইকারের মাঝে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা চামড়া ব্যবসায়ীরা

• ট্যানারি মালিক ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে বাজার• সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনে হতাশ ক্ষুদ্র-মৌসুমী ব্যবসায়ীরা• ব্যাংক বন্ধ ও বকেয়া অনাদায়ে নগদ টাকার সংকট

Advertisement

যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি এলাকা থেকে ৩০০ পিস গরুর চামড়া নিয়ে শনিবারের হাটে এসেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পুলিন দাশ। সাড়ে ৭০০ টাকা করে দেড়শ পিস চামড়া বিক্রি করেছেন। কিন্তু এই চামড়া কেনা ও প্রক্রিয়াজাতে খরচ পড়েছে হাজারের ওপরে। আড়াইশ টাকা করে লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। বাকি দেড়শ পিস চামড়ার দাম ৪০০-৫০০’র বেশি কেউ বলছে না। তিনি ৩০০ পিস ছাগলের চামড়াও এনেছিলেন। সেগুলো ৫০-৭০ টাকায় বিক্রি করেছেন।

পুলিন দাশ বলেন, সরকার চামড়ার যে দাম দিয়েছে, সে অনুযায়ী মাঠ থেকে তারা চামড়া কিনেছেন। কিন্তু এখন হাটে দাম মিলছে না। সরকারের দামে চামড়া কিনে তাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।

আরও পড়ুন:ঢাকায় সংগ্রহ হয়েছে ৭৫ হাজার চামড়া, বাইরের জন্য অপেক্ষা সিন্ডিকেটের কবলে চামড়া বাজার, হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

চামড়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বসুন্দিয়ার ব্যবসায়ী পঞ্চানন বিশ্বাস। তিনি বলেন, সরকারের কথা বিশ্বাস করে চামড়া কিনেছি। প্রতিটি চামড়া খরচসহ (লবণ, শ্রমিক মজুরি ও পরিবহন ব্যয়) ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পড়েছে। কিন্তু হাটে আড়তদাররা ৫০০ টাকার বেশি দাম বলছে না। ২০০ চামড়া হাটে এনে এখন কপাল ঠুকছেন তিনি।

Advertisement

শুধু পুলিন দাস কিংবা পঞ্চানন বিশ্বাসই নন, শনিবার রাজারহাটে চামড়া নিয়ে আসা কয়েকশ ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীর অবস্থা কম-বেশি একই রকম ছিল।

তারা বলছেন, সরকারের মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেছেন। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন না।

আর পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সরকারতো চামড়া কেনে না। ট্যানারি মালিকরা যেভাবে দাম দেবে, সেভাবেই চামড়ার বেচাকেনা করতে হবে।’

সব মিলিয়ে সুদিন ফেরেনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম রাজারহাটে। ত্রিমুখী সংকটে ঈদ পরবর্তী সর্ববৃহৎ হাটেও হাসি নেই ক্ষুদ্র ও মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের মুখে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, ঢাকার আড়তদার ও ট্যানারি সংশ্লিষ্টদের হাটে না আসা এবং নগদ টাকার সংকটে বাজারে চামড়ার দাম নেই। ফলে লোকসানেই চামড়া বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের।

Advertisement

শনিবার (১৪ জুন) কোরবানি ঈদ পরবর্তী সর্ববৃহৎ হাটে এই চিত্র উঠে এসেছে। এদিন প্রায় ২০ হাজার গরুর চামড়া আমদানি হলেও ক্রেতা সংকটে হাটে মন্দাভাব বিরাজ করে।

আরও পড়ুন:পোস্তায় চামড়া এসেছে কম, পূরণ হয়নি সংরক্ষণের টার্গেট শুধু ভারত-চীনে নয় ইউরোপেও চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে

রাজারহাট ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শনিবার (৭ জুন) কোরবানি ঈদ হওয়ায় মঙ্গলবার (১০ জুন) ছিল ঈদ পরবর্তী প্রথম হাট। ওইদিন হাটে কিছু বেচাকেনা হলেও বড় হাট শনিবারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবাই। এ কারণে শনিবারের (১৪ জুন) হাটে প্রায় ২০ হাজার গরুর চামড়া আমদানি হয়েছিল। সেইসঙ্গে কয়েক হাজার ছাগলের চামড়াও আমদানি হয়েছিল। সবমিলিয়ে শনিবারের হাটে প্রায় দেড় কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনার খবর পাওয়া গেছে।

শনিবার রাজারহাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পরিবহনে করে চামড়া এনে স্তূপ করে রেখেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার চামড়া নিয়ে হাজির হতে থাকেন এই হাটে। সবমিলিয়ে হাটে প্রায় ২০ হাজার গরুর চামড়া ও কয়েক হাজার ছাগলের চামড়া আমদানি হয়। কিন্তু হাটে চামড়া আমদানি ও বিক্রেতার তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা কম। ফলে প্রতিযোগিতা না থাকায় বাড়েনি চামড়ার দাম। মঙ্গলবারের হাটের মতো এদিনও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৬০০ এবং বড় চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া প্রতি পিস ২০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এই দামে হতাশা প্রকাশ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাটে কোরবানির পশুর চামড়ার যে দাম, তাতে তারা পুঁজি হারাতে বসেছেন। অথচ মাঠ পর্যায় থেকে তারা এর কমপক্ষে দেড়গুণ ব্যয় করে চামড়া হাটে নিয়ে এসেছেন।

তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। মূলত ট্যানারি মালিক-আড়তদারদের সিন্ডিকেট এই চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেটের কারণে তারা পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

অপরদিকে স্থানীয় আড়তদার ও চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের হাটে ঢাকা থেকে বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধি রাজারহাটে আসেনি। ফলে বিক্রেতার তুলনায় ক্রেতা কম। এছাড়া দশদিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় সবার কাছেই নগদ টাকার সংকট রয়েছে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি ঢাকার ব্যবসায়ী, ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা টাকা আদায় না হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটে বাজারে মন্দাভাব রয়েছে।

নড়াইলের লোহাগড়া থেকে রাজারহাটে চামড়া নিয়ে আসা শুভ বিশ্বাস জানান, তিনি ভালো মানের ১০২ পিস চামড়া নিয়ে এসেছেন। পাইকাররা দাম বলছেন এক হাজার টাকা করে। লবণ, শ্রমিক খরচ দিয়ে চামড়াগুলো এক হাজার টাকা পড়ে গেছে। তাই আরেকটু দামের আশায় আছেন, তাহলে পুঁজির সঙ্গে পরিবহন খরচটা উঠবে।

নড়াইলের লোহাগড়া থেকে রাজারহাটে এসেছিলেন পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান। তিনি রাজারহাট থেকে চামড়া কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন। ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ৭৫ টাকা পর্যন্ত দামে চামড়া কিনেছেন। হাজার খানেক চামড়া কিনেছেন। আরও কিছু চামড়া কিনবেন।

আব্দুল হান্নান জানান, রাজারহাটে এবার ঢাকার ব্যবসায়ীরা আসেনি। দশদিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় নগদ টাকার সংকটে হয়ত এমনটি ঘটেছে। ক্রেতা কম, বিক্রেতা বেশি। আবার স্থানীয় ক্রেতাদের কাছেও নগদ টাকার ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রতিযোগিতা না থাকায় দাম ওঠেনি। পরবর্তী হাটগুলোতে দাম সামান্য বাড়লেও তখন ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া থাকবে না। ফলে বাজার ভালো হলে আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন।

রাজারহাটের আরেক চামড়া ব্যবসায়ী খুরশীদ আলম বাবু জানান, সরকার দাম বাড়িয়ে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সরকারতো আর চামড়া কেনে না। চামড়া কেনে ট্যানারি মালিকরা। সরকার তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করেছে বলে মনে হয় না। ট্যানারি মালিকরা যে ধরনের দাম দিচ্ছে, হাটেও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ঈদ পরবর্তী প্রথম হাটের চামড়ার দাম সরকার নির্ধারিত দামের ধারে-কাছেও ছিল না। শনিবারের হাটেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলে সরকারের ঘোষণায় মাঠ থেকে থেকে বাড়তি দামে চামড়া কিনে ছোট ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বড় লসের মুখে পড়েছেন। আর হাটে বেশি ক্রেতা না আসায় কেনার প্রতিযোগিতা নেই। ফলে বাজারও বাড়ছে না।

বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহসভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড বলেন, মঙ্গলবার প্রথম ও ছোট হাট হওয়ায় এদিন ছয় হাজারের মতো গরুর চামড়া উঠেছিল। শনিবারের হাটে প্রায় ২০ হাজার গরুর চামড়া ও কিছু ছাগলের চামড়ার আমদানি হয়। কিন্তু দামে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। বেশিরভাগই চামড়াই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। সবমিলিয়ে দেড় কোটি টাকার মতো বেচাবিক্রি হতে পারে। তবে এতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। মূলত সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের সামঞ্জস্যতা নেই বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট। ঢাকার পরে দেশের অন্যতম বৃহত্তর চামড়ার মোকাম এটি। এই মোকামে তিন শতাধিক আড়ত রয়েছে। সপ্তাহে দুইদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। এখানে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন। এই হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। প্রতিবছর কোরবানির ঈদ ঘিরে কয়েকটি হাটবারে রাজারহাটে প্রায় দশ কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে।

এফএ/এমএস