করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, লকডাউনে ফিরেছে ইউরোপ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৩৭ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০২০

চলতি গ্রীষ্মের শুরুতে ইউরোপের অনেক দেশই ভেবেছিল যে জীবন-যাত্রা হয়তো আবারও স্বাভাবিক গতিতে ফিরে যাবে। প্যারিসের মিউজিয়াম এবং বার্সেলোনার ক্যাফেগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছিল। যদিও আগের মতো চিরচেনা রূপে দেখা যায়নি, সবক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে।

জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কের লোকজন ছুটি কাটাতে ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন বীচে ঘুরে বেরিয়েছেন। চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে যখন শিশুরা স্কুলে ফিরতে শুরু করে তখন থেকেই নতুন করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার বেশ উদ্বিগ্ন হলেও কঠোর সামাজিক-দূরত্বের মতো বিধি-নিষেধ পুনরায় জারি করার বিষয়ে অনেক দেশেরই কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের এমন সিদ্ধান্তের জন্যই তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ইউরোপজুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। অনেক দেশেই করোনা সংক্রমণ আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিভিন্ন দেশে করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়িয়ে দেওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে বলে জানানো হয়েছে। তবে মৃত্যুহার এখনও কিছুটা কম আছে। হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। বেশিরভাগ দেশই এই গ্রীষ্মকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সে কারণেই এখন তাদের ভুগতে হচ্ছে। অনেক দেশই এখন আবার নতুন করে কড়াকড়ি ও বিধি-নিষেধ জারি করতে বাধ্য হয়েছে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেস্টুরেন্ট-বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারফিউ ও জরুরি অবস্থাও জারি করেছে বেশ কিছু দেশ। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্পেন। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কারফিউয়ের পাশাপাশি দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

দেশটিতে রোববার থেকেই রাত্রিকালীন কারফিউ কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। রাত ১১ থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

জরুরি অবস্থা জারির কারণে স্থানীয় প্রশাসন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে লোকজনের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। দেশজুড়ে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ জারি করা হয়েছে। তবে এই সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নতুন বিধি-নিষেধের কারণে গণজমায়েত বা ব্যক্তিগত সাক্ষাতেও কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ছয়জন একসঙ্গে সমবেত হতে পারবেন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান বলছে, স্পেনে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ ১০ হাজার ৩৭২। এর মধ্যে মারা গেছে ৩৪ হাজার ৭৫২ জন।

সংক্রমণে স্পেনের কাছাকাছি রয়েছে ফ্রান্স। দেশটিতে করোনার দৈনিক সংক্রমণ অর্ধলাখ ছাড়িয়ে গেছে। যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ১০ জন। এখন পর্যন্ত দেশটিতে এটাই সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা।

পাবলিক হেলথ ফ্রান্স (এসপিএফ) জানিয়েছে, দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে আরও ১১৬ জন। দেশটিতে করোনা মহামারি শুরুর পর এখন পর্যন্ত সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৬১ জনের।

শুক্রবার সপ্তম দেশ হিসেবে দশ লাখ করোনার সংক্রমণ ছাড়িয়েছে ফ্রান্সে। সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী প্যারিসসহ দেশজুড়ে আবারও রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করেছে দেশটির সরকার। ফ্রান্সে দৈনিক গড় মৃত্যু টানা দশদিন ধরে বাড়ছেই।

সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সতর্ক করেছেন যে, করোনার প্রভাব আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত থাকবে। এক বিবৃতিতে বলেন, তার দেশের লোকজনকে কমপক্ষে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান বলছে, ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০৭। এর মধ্যে মারা গেছে ৩৪ হাজার ৭৬১ জন। তবে ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছে ১১ লাখ ৩২২ জন।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে সময় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি এবং স্পেন ছিল করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত। বর্তমানে বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডেও করোনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

বেলজিয়ামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফ্রাংক ভানদেনব্রুক সতর্ক করে বলেছেন, আমরা হয়তো একটি বিপর্যয়ের খুব কাছাকাছি রয়েছি। দেশটিতে সব ধরনের রেস্টুরেন্ট ও বার বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া মধ্যরাত থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার ৩১। এর মধ্যে মারা গেছে ১০ হাজার ৮১০ জন।

এদিকে, নেদারল্যান্ডেও সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি সপ্তাহে দেশজুড়ে চার সপ্তাহের জন্য রেস্টুরেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৯১ হাজার ২৫৪। এর মধ্যে মারা গেছে ৭ হাজার ৪৬ জন।

ইউরোপে প্রথমদিকে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর ইতালির অবস্থা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশটি যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। মাঝে কিছুদিন সংক্রমণ কিছুটা কম থাকলেও নতুন করে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৭৮২। অপরদিকে সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৮ জনের।

পোল্যান্ডে রেড জোন লকডাউন জারি করা হয়েছে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেস্টুরেন্টে আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ৪৮ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্টের অবস্থা ভালো রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তার মুখপাত্র।

দেশটিতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিধি-নিষেধ জারি করা হয়েছে। সেখানে পাঁচজনের বেশি মানুষের সমবেত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। এছাড়া ছোট শিশুদের অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক কারও সঙ্গে বের হতে হবে। অপরদিকে, ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের বাড়ির বাইরে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৮৮। অপরদিকে মারা গেছে ৪ হাজার ৪৩৮ জন।

জার্মানিতে করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বার্লিনে সংক্রমণ বাড়ছেই। করোনার সংক্রমণ যেসব এলাকায় বেশি সেখানে রেস্টুরেন্ট এবং বার আগেই বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মাস্ক ব্যবহারেও নির্দেশনা জারি হয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬৩৭। এর মধ্যে মারা গেছে ১০ হাজার ১৩৮ জন।

তবে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখেছে যুক্তরাজ্য। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৮শ। এর মধ্যে মারা গেছে ৪৪ হাজার ৮৯৬ জন। লাতিন আমেরিকার পর দ্বিতীয় অঞ্চল হিসেবে মহামারি করোনায় আড়াই লাখ মৃত্যু ছাড়িয়েছে ইউরোপে। পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

গত বৃহস্পতিবার ইউরোপে প্রথমবারের মতো একদিনে দুই লাখের বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ ছাড়া চলতি সপ্তাহে দৈনিক সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলীয় বেশিরভাগ দেশে। ফলে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।

বিশ্বে মহামারি করোনায় মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশ এবং মোট শনাক্ত সংক্রমণের ২২ শতাংশই ইউরোপে। ওই অঞ্চলে এ পর্যন্ত শনাক্ত ৮০ লাখের বেশি কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে যে আড়াই লাখ মারা গেছে এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই কয়েকটি দেশে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করতে পারে না ব্রিটেন আর তাই মহামারির বিস্তার ঠেকাতে কিংবা লাগাম টানতে বিধি-নিষেধসহ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।