থানা ছাড়ছে হাইওয়ে পুলিশ ধরছে
আব্দুল আলিম (২৫)। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পার্শ্ববর্তী সুখানপুকুর থেকে এসে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মহাস্থানগড় পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান প্রতিদিন। মহাসড়কে রিকশা চলাচল নিষেধ। এরপরও তিনি রিকশা কিভাবে চালাচ্ছেন জানতে চাইলে বলেন, `পুলিশের সঙ্গে চুক্তি আছে। তারকেরে লোক প্রতিদিন ৫০ ট্যাকা করে ল্যায়। তাই কুনু সমস্যা হয় না।`
সিএনজিচালক মনির, আবুল, আলিম ও বাদশা মিয়াও জানালেন, একই ধরনের কথা। তারা বগুড়া থেকে শিবগঞ্জ, দুপচাঁচিয়া, মোকামতলা ও সোনাতলা রুটে সিএসজি চালায়। এই রুটগুলো মহাসড়ক দিয়েই চলতে হয়। যার কারণে পুলিশের সঙ্গে চুক্তি না করে উপাই নেই।
মনির ও বাদশা জানান, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বগুড়া সদর থানাসহ অন্যান্য থানার সংশ্লিষ্ট ফাঁড়ি পুলিশের সঙ্গে তাদের মৌখিক চুক্তি হয়েছে। নম্বর ছাড়া ৮০ টাকা আর নম্বর থাকলে ৫০ টাকা দিতে হবে পুলিশের দালালকে। বিনিময়ে অবাধে মহাসড়কে চলাচল করার সুযোগ পাবে তারা।
ব্যাটারি রিকশা চালক মঈন উদ্দীন (৩০) এই মহাসড়কে রিকশা চালান। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। আর টাকার কাছে আইন বলতে কিছু নাই।’
বিষয়টি খোলাসা করে তিনি বলেন, প্রতিদিন পুলিশকে টাকা দিয়ে মহাসড়কে রিকশা চালায়। এ রকম বগুড়ার বিভিন্ন মহাসড়কে প্রায় ৫ হাজার রিকশা ও সিএনজি চলাচল করছে।
মঈনের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রতি রিকশা ও সিএনজি থেকে গড়ে ৫০টাকা করে হলেও পাঁচ হাজার রিকশা/সিএনজি থেকে চাঁদা ওঠে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ৩০ দিনে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ লাখে। নিষিদ্ধ হবার পরেও মহাসড়কে এই অবৈধ চাঁদা বাণিজ্য করছে পুলিশ। আর চাঁদার বদৌলতেই উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে এখন রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, নছিমন, করিমসহ সবই চলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে বিভিন্ন ভাবে চাঁদা আদায় হলেও গত ১৫ তারিখ থেকে চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করে মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি দেয় জেলার বিভিন্ন থানা পুলিশ। এর মধ্যে রয়েছে শিবগঞ্জ, সদর, কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি, শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, শেরপুর থানা পুলিশ। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কয়েকটি ফাঁড়িও এই চুক্তির মধ্যে রয়েছে। তাদের নিযুক্ত করা দালালের মাধ্যমে এসব চাঁদার টাকা চলে যায় সংশ্লিষ্ট থানা ও ফাঁড়িতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দালাল জানান, বেশির ভাগ সময়ই থানার ওসি কিংবা ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সরাসরি এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। আমরা শুধু চাঁদার টাকা তাদের হাতে তুলে দেই। বিনিময়ে আমরা কিছু পেয়ে থাকি।
এদিকে, মহাসড়কে তিনচাকার যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে হাইওয়ে পুলিশ। রোববার সকাল থেকে বগুড়া শহরতলীর মাটিডালি মোড়ে হাইওয়ে পুলিশ এ অভিযান শুরু করে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত এ অভিযান অব্যহত হয়েছে। মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবার কারণে এই অভিযান। প্রথম দিনেই প্রায় ৫০টি সিএনজি আটক করা হয়।
বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মহিদুল ইসলাম জানান, কোনো ভাবেই মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলতে দেয়া হবে না। অভিযানের পরেও কেউ বের হলে প্রয়োজনে গাড়ি আটক করা হবে। আর চাঁদা আদায়ের জন্য কেউ অবৈধ ভাবে চলাচলের অনুমতি দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বগুড়ার মহাস্থান পয়েন্টে মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় অটোরিকশা চালক রহমান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচলের নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে মাস খানেক দিন প্রশাসনের কড়াকড়ি ছিল। এখন বলতে গেলে এখন সব শিথিল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই আমরা সবাই মহাসড়কে অটোরিকশা নিয়ে যাচ্ছি। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গোকুল, মহাস্থান থেকে ফাঁসিতলা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক সরেজমিনে ঘুরে কথা বলে এসব চিত্র ফুঁটে উঠেছে।
দুপুর ১২টা থেকে ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত মোকামতলা বন্দরে অবস্থান কালে দেখা গেছে, বগুড়া, শিবগঞ্জ, সোনাতলা রুটে সিএনজি, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি অবাধে চলছে। ৩০ মিনিটে এই স্থানে প্রায় পঞ্চাশের অধিক সিএনজি ও অটোরিকশা ছেড়ে গেছে। বগুড়ার মাটিডালি মোড়েও একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। তবে সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য বেশি বলে মনে হয়েছে।
মাটিডালি মোড়ে কর্তব্যরত একজন পুলিশ সদস্য জানান, রিকশা ও অটোরিকশার পরিমাণ গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। সে হারে আমাদের জনবল বাড়েনি। একদিকে আটকে দিলে অন্যদিক মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে। তাছাড়া বিআরটিএ থেকেও তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে আমরাও হাতগুটে বসে থাকি।
২০১৫ সালের ২৭ জুলাই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রজ্ঞাপনে, সড়কের নিরাপত্তা বিধানে সব জাতীয় মহাসড়কে থ্রি হুইলার অটোরিকশা/অটোটেম্পো এবং সব ধরনের অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ এবং ১ আগস্ট থেকে তা কার্যকর করা হলেও বাস্তব চিত্র এখন ঠিক এ রকম।
জানতে চাইলে বগুড়া পুলিশ সুপার (এসপি) আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা সব সময়ই তৎপর থাকি। নির্দেশনা দেয়া আছে এ মহাসড়কে চলতে না দেয়ার। এরপরও কেউ অবৈধ সুবিধা নিয়ে সুযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এআরএ/এবিএস