গাজার সংঘাত শেষ হবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৩ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০২৩
ছবি সংগৃহীত

গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সম্ভবত এখন একেবারে চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়ের শর্তে যে যুদ্ধবিরতি চলছে তা শেষ হতে হয়তো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) চার থেকে নয় দিন সময় নেবে। তবে সেটা নির্ভর করছে হামাস কতজন জিম্মিকে মুক্তি দিতে চায় তার ওপর।

ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, জিম্মি মুক্তির এ প্রক্রিয়া শেষ হলেই গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার যে যুদ্ধ সেটা আবারও শুরু হবে এবং তা শেষ হতে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। কিন্তু যদি ইসরায়েলি বাহিনী এরপর গাজার দক্ষিণে মনোযোগ দেয় তবে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: হামাসের সামরিক শাখার শীর্ষ ৪ নেতা নিহত

ইসরায়েল শপথ নিয়েছে যে, হামাস যেখানেই থাকবে তাদের ধ্বংস করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও মোহাম্মদ দেইফ অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে দক্ষিণেই অবস্থান করছেন এবং সম্ভবত ইসরায়েলি জিম্মিদের একটা বড় অংশও তাদের সঙ্গেই আছে।

এখন যদি ইসরায়েল উত্তরে যেটা করেছে সেই একই রকম অভিযান দক্ষিণেও করতে চায় তাহলে পশ্চিমাদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তখনও অটুট থাকবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

গাজা উপত্যকার আনুমানিক ২২ লাখ মানুষ এখন দক্ষিণের দুই তৃতীয়াংশ অংশে এসে জমায়েত হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন গৃহহীন ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সামনে কি তাহলে আরও বড় মানবিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে?

এছাড়া আল-মাওয়াইসিতে বালুময় মাঠের মধ্যে স্থাপিত তাবুতে আশ্রয় নেওয়া শত শত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকও আছেন। ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউ) বলছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ গাজায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগ এখন দক্ষিণে গাদাগাদি করে থাকছে।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে কারণ হাজার হাজার মানুষ স্কুল, হাসপাতাল এবং তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। বিপদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে শীতের আগাম বৃষ্টি। কিছু জায়গায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে একটি সমাধানের কথা বলা হচ্ছে। আল মাওয়াইসির তথাকথিত নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করা। এটি হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের পাশে একটি সংকীর্ণ কৃষি জমির এলাকা, যা মিশর সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত।

গত সপ্তাহে খান ইউনিসের আশেপাশের এলাকায় আকাশ থেকে লিফলেট ফেলে বিমান হামলার ব্যাপারে সতর্ক করা হয় এবং বাসিন্দাদের আরও দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে সরে যেতে বলা হয়। বৃহস্পতিবার সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে আইডিএফের আরবি গণমাধ্যমের মুখপাত্র আভিচায় আদরে বলেন, গাজাবাসীকে আল মাউয়াইসি উপযুক্ত পরিবেশ দেবে তাদের প্রিয়জনদের রক্ষা করার জন্য।

কিন্তু এটা আসলে কতোটা বাস্তবসম্মত। যখন পাশে যুদ্ধ চলছে তখন এরকম একটি জায়গায় ২০ লাখের বেশি লোক কিভাবে আশ্রয় নেবে? আল মাউয়াইসির পরিবেশই বা আসলে কতোটা উপযুক্ত?

আরও পড়ুন: ‘দেড় মাসে গাজায় ৪০ হাজার টন বোমা ফেলেছে ইসরায়েল’

ইসরায়েল যে জায়গাটা কথা বলছে তার প্রস্থ ২.৫ কিলোমিটার আর দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটারের মতো। ফিলিস্তিন বিষয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েল সরকারের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন ড. মাইকেল মিলশটেইন। তিনি বলেন, এটা একটা খুবই সুন্দর এবং উপযুক্ত জায়গা, তবে বেশ ছোট। তবে এ বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলোর মতামত অবশ্য আলাদা।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক জুলিয়েট টোওমা, এটা একেবারেই সামান্য একটা ভূমি। এখানে কিচ্ছু নেই, শুধু বালু আর পাম গাছ ছাড়া।

এখন যে কোনো জায়গা যেখানে জরুরি অবকাঠামো নেই-যেমন হাসপাতাল, এরকম জায়গায় একসাথে হাজারো বাস্তুচ্যুত লোককে নিয়ে আসাটা জাতিসংঘের জন্য একটা বিরাট মানবিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। হয়তো তাঁবুতেই জরুরি অবকাঠামো স্থাপন করতে হবে।

সেই সঙ্গে মানসিক ধাক্কা তো আছেই। কারণ গাজার বেশিরভাগ অধিবাসী আসলে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে শরণার্থী হিসেবেই বেড়ে উঠেছে। গাজায় এরই মধ্যে ৮টি শরণার্থী শিবির আছে, যা গত কয়েক দশক ধরে ব্যস্ত, জনাকীর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ এখন সেখানে আরেকটা শরণার্থী শিবির স্থাপন করতে চায় না।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, এটা দাতা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব যে কীভাবে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সাহায্য আল মাউয়াইসিতে এসে পৌঁছাবে- তা নিশ্চিত করা। ওই সীমান্ত থেকে আঅল মাউয়াইসি প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। তারা এখনো পরিষ্কার করেনি যে পুরো ব্যাপারটি কীভাবে ঘটবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, তারা ইসরায়েলের সাথে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে আরও নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টি করা যায়- যেমন গাজার একেবারে দক্ষিণে দাহানিয়ায় একটি।

জিম্মি ছেড়ে দেয়ার শর্ত অনুযায়ী, শুক্রবার থেকে ইসরায়েল ২০০ টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রতিদিন ঢুতে দেবে, যা সাম্প্রতিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তা করছে, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন এনজিও মিলে এমন ১৮টি সংস্থার প্রধান কর্মকর্তারা গত ১৬ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয়। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা কোনো নিরাপদ অঞ্চল স্থাপনে অংশগ্রহণ করবো না যতক্ষণ সেটি সবার সম্মতিতে না হবে।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখানে সব পক্ষের মধ্যে ইসরায়েল, হামাস ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে।

আল মাউয়াইসির নাম না নিয়ে এই বিবৃতিতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, ইসরায়েলের এই অনৈতিক প্রস্তাব আরও অসংখ্য জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এখানে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের একজন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস। তিনি এই পরিকল্পনাকে একটা বিপর্যয়ের ব্যবস্থাপত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি বলেন, এই সামান্য জায়গায় এত লোককে এক সঙ্গে করলে, যেখানে কোনো অবকাঠামো বা সেবার সুবিধা নেই, সেটা আগে থেকেই বিপদে থাকা লোকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এজন্য সবসময় হামাসকেই দায়ী করে এসেছে। এসব মানবিক ঝুঁকি সম্পর্কে খুব একটা পরোয়াও দেখা যায় না তাদের মধ্যে। তারা বলছে, আল মাউয়াইসি হল সেই এলাকা যেখানে ইসরায়েল কোনো হামলা চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এটা ভয়ংকর হতে চলেছে, তবে তারা মারা যাবে না বলে উল্লেখ করেন আইডিএফের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রিচার্ড হেক্ট। ইসরায়েলের জন্য এটা সামরিক দিক থেকে দরকারি একটি পদক্ষেপ। তারা বলছে, হামাস যেভাবে গাজা শহরে আছে, খান ইউনিস এবং রাফায় তাদের যোদ্ধা এবং অবকাঠামোও আছে। যে কোরো হামলার আগে বেসামরিক লোকদের সরিয়ে নেওয়াটা হামাসকে দমনের পথে মানবিক উপায় বলে যুক্তি দিচ্ছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের জনগণও এই পরিস্থিতি পছন্দ করছে না যে শীতের বৃষ্টির মধ্যে গাজার মানুষজন আল মাউয়াইসিতে গিয়ে থাকবে। কিন্তু এর বিকল্প কী? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ইসরায়েলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইয়াকব আমিদরোর।

তিনি বলেন, কারো কাছে যদি কোনো পরিকল্পনা থাকে যে এটা না করে কীভাবে হামাসকে ধ্বংস করা যাবে তাহলে দয়া করে সেটা আমাদের বলুন।

অতিরিক্ত জনসংখ্যা আর তীব্র শীতে আরও কয়েক মাসের দুর্ভোগের আশঙ্কা গাজায় চলমান ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দেবে। এই অঞ্চলে আরেকটা বড় স্থল অভিযান পরিচালনা করা হলে তা বেসামরিক নাগরিক হতাহত ও বাস্তুচ্যুত হবার শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেবে, যা ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিও আরও কমিয়ে দেয়ার হুমকি তৈরি করবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

এখানে প্রশ্ন হল পশ্চিমারা কতদিন ধৈর্য্য ধরে থাকবে? নেতানিয়াহুর সরকার জানে গত ৭ অক্টোবর ঘটে যাওয়া হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর পশ্চিমাদের জমা করে রাখা সহানুভূতির ওপর তারা ভরসা করতে পারে। কিন্তু ইসরায়েল এটাও জানে যে, এই সহানুভূতি অন্তহীন নয়।

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাম্পাসের কাছে ৩ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীকে গুলি

যখন বন্দী বিনিময়ের বিরতি শেষে ইসরায়েল আবারও সামরিক অভিযান শুরু করবে তখন যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে। ড. এলাল হুলাতা বলেন, আমার আশা যে বিরতির পর আন্তর্জাতিক চাপ এটার পথে বাধা হবে না। তিনি ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

শীতের আগমন, অভিযানের চূড়ান্ত পদক্ষেপের দিকে ইসরায়েলের প্রস্তুতি এবং বেসামরিক লোকদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে না আসা বলে দেয় গাজার দীর্ঘ যন্ত্রণা অব্যাহত থাকবে। এই পরিস্থিতি হয়তো আরও বেশি খারাপও হতে পারে।

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।