কায়ান্ট দুর্বল হলেও দুশ্চিন্তা কাটছে না উপকূলে
দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত। বাতাসে দুলছে ধানের শীষ। ঘরে ঘরে চলছে নবান্নোৎসবের প্রস্তুতি। কষ্টার্জিত ফসলে দেখা মিলছে কিষাণ-কিষাণীর হাসি। তবে মাঠভরা ধান ক্ষেত দেখে তাদের মুখে হাসি দেখা গেলেও কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। এমন চিত্র দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের।
কৃষকরা জানিয়েছেন, কার্তিক মাসের এ সময় উপকূলীয় অঞ্চলে একের পর এক ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। গত বছরও এমনটি হয়েছে। তাছাড়া সাগরে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় কায়ান্ট। যদিও আবহাওয়া অফিস বলছে, এটি এরই মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে পুরোপুরি কেটে যায়নি। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও দুশ্চিন্তা কাটছে না কৃষকের।
উপকূলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠ ভরা ধানের শীষে এখনো চাল পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। সামান্য ঝড় হলেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। এতে পথে বসতে হতে পারে লাখ লাখ কৃষক পরিবারকে।
এক সপ্তাহ ধরে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালী, সুবর্ণচর, চরজব্বর, হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ, বয়ারচর, নলেরচর, চঙ্গলিয়ারচর, চরবাটা, খাসেরহাট, ক্যারিংচর, ঢালচর ও মনপুরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। যেদিকেই চোখ যায় শুধুই ধান ক্ষেতের বাহারি রূপ। সব পরিচর্যা শেষে ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় তারা। আর কিছুদিন গেলেই সবার ঘর ভরে যাবে ধানে। সকাল-বিকাল প্রতিটি ক্ষেত গিয়ে দেখে আসছেন কৃষকরা। মাঝে মাঝে দেখছেন আকাশের দিকেও।
গত কয়েকদিন ধরে ঘূর্ণিঝড় কায়ান্ট দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করলেও আকাশের অবস্থা ছিলো বেশ ভালো। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত থেকে উপকূলের আকাশে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের খবরে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও আকাশের এমন অবস্থা আবারো এনে দিয়েছে তাদের মনে দুশ্চিন্তা। হাসি মুখ আবারো মলিন হতে শুরু করেছে। ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করছেন তারা। বারবার ঘোরাফেরা করছেন ধান ক্ষেতের আশপাশে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড় কায়ান্ট অবস্থান করছে। এটি সামান্য পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদফতর আরো জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কায়ান্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে দেশের কোথাও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
হাতিয়ার বয়ারচরের কৃষক আইয়ুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষকের জন্য বর্তমান সময়টি যেমন ভালো ঠিক তেমন খারাপ। কেননা এ সময়েই ঝড়-বাদল বেশি দেখা যায়। যে বছর এ মাসে ঘূর্ণিঝড় হবে সে বছরটি কৃষকের জন্য দুর্দিন।’
তিনি বলেন, এ বছর ফসলের মাঠ অনেক ভালো। ধান পাকতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যে কাটা শুরু হবে। কিছু কিছু ক্ষেত পেকে গেছে। আবার কিছু ধান এখনো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। যেসব ধান পরিপূর্ণ হয়নি সেগুলোর জন্য ভয় রয়েছে। সামান্য বাতাসের কবলে পড়লে ধানগুলো মাটিতে শুয়ে যাবে। তখন সেসব ধান চিটা হয়ে যাবে।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে এই কৃষক বলেন, ‘খবরে শুনেছি সাগরে ঘূর্ণিঝড় বইছে। আবার দুর্বলও হয়ে পড়েছে। আকাশে তো তা দেখছি না। খোদা না করুক এমন কিছু যদি আঘাত হানে তাহলে আমরা পথে বসে যাবো। পুরো বছরের সব অর্থ এই ক্ষেতের পেছনে দিয়ে দিয়েছি। এখন ফসল যদি ঘরে না আনতে পারি তাহলে সারা বছর কাটবে কীভাবে?’
নিঝুমদ্বীপের কৃষক ছায়েদল হক বলেন, ‘এইবার ৩ কানি জইন (জমিন) চাষ কচ্ছি (করছি)। হাজার চল্লিশেক (৪০ হাজার) টিয়া (টাকা) চালান (মূলধন) গেছে। আল্লাই দিলে মাঠ ভালা আছে। যদি কোনো বিপদাপদ না আইয়ে (আসে), তাইলে (তাহলে) ২০০ থেকে ২১০ মণ ধান হামু (পাব)। আসতে আসতে কাটাল্লাই (কাটতে) হস্তুতি (প্রস্তুতি) নিচ্ছি। বৃষ্টি-কাদল আইলে (আসলে) কী অয় (হয়) আল্লাই জানে।’
সোনাদিয়া ইউনিয়নের কৃষক আবুল খায়ের বলেন, ‘ভাইরে মনতো ভালা নাই। ধান খেতের দিকে চাইলে মন ভরি যা। আসমানের (আকাশের) দিকে দেইখলে (দেখলে) চিন্তা লাগে। উপরওয়ালার হাতে চাই (ছেড়ে) দিছি। হেতে (তিনি) যা করে তাই অইবো (হবে)।’
এমএসএস/এআরএস/এবিএস